সফট স্কীল কি ও কেন

আমি আপনি সবাইকে বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন দক্ষতা অর্জন করতে হয়। সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে জীবিকা অর্জন করি, অফিসের পরিবেশে কাজ করি, পরিবার ও সমাজে একে অপরের সাথে মিলেমিশে থাকি। এই দক্ষতাগুলো তাদের ভূমিকা, স্থান, কাল, ও পাত্র ভেদে বিভিন্ন নাম নেয়।

মানুষের সাথে মানুষের মিলেমিশে কাজ করা, ভাব বিনিময়, বা কাউকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেবার জন্য যে দক্ষতাগুলো লাগে সেগুলোকে ইংরেজিতে বলে সফট স্কীল। বাংলায় আমরা একে সহায়ক দক্ষতা, চাকুরি পাবার দক্ষতা , ইত্যাদি বলতে পারি। আর যখন এই দক্ষতাগুলো ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে কাজে লাগে তখন তাকে লাইফ স্কীল বা জীবনের দক্ষতাও বলতে পারি।

সফট স্কীল বা সহায়ক দক্ষতার সাথে হার্ড স্কীল ও টেকনিক্যাল স্কীলের নিবিড় সর্ম্পক আছে। কোন কাজ করার জন্য যে দক্ষতাগুলো না থাকলে আপনি কাজই করতে পারবেন না সেগুলো হার্ড স্কীল বা টেকনিক্যাল স্কীল। যেমনঃ ডাক্তারের মেডিকেল সাইন্স জানতে হবে, একাউনন্ট্যান্টের একাউনন্টিং জানতে হবে, প্রোগ্রামারের কোডিং জানতে হবে, আইনজীবির আইন জানতে হবে।

হার্ড স্কীল বা টেকনিক্যাল স্কীল হচ্ছে মানব দেহের হাড়ের কাঠামো বা কঙ্কালের মত। আর সফট স্কীল বা সহায়ক দক্ষতা হচ্ছে শরীরের মাংশ, চামড়া, নাক, কান, চোখ, ও অন্যান্য অঙ্গের মত। হার্ড স্কীল বা টেকনিক্যাল ও সফট স্কীল বা সহায়ক দক্ষতা একে অপরের পরিপূরক।

শুধু হার্ড স্কীল বা টেকনিক্যাল দিয়ে কোন কাজ করা যায়? যায়। একটা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যখন একজনের কাজের জন্য অন্য জনের সাথে কোন ভাববিনিময় বা আলোচনার প্রয়োজন হয়না, সেখানে সম্ভব। আবার একই পরিবেশে কাজ করলে, কাজের সর্ম্পক না থাকলেও একসাথে কেন্টিনে খাবার খাওয়া, একই এলাকার হলে একসাথে যাতায়ত করা, ইত্যাদি পারস্পরিক ভাববিনিময় ছাড়া সম্ভব নয়। তাহলে কাজকে কেন্দ্র করে “সমাজ” গড়ে উঠে সেখানেও স্কীল বা সহায়ক দক্ষতা প্রয়োজন।

আমরা এই আলোচনায় এই দক্ষতাগুলোকে সফট স্কীল বা সহায়ক দক্ষতা বলব। কারণ, আমরা এই লেখায় নিজের ক্যারিয়ার শুরু করা বা তাতে সাফল্য লাভের জন্য এই দক্ষতাগুলোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরব।

সফট স্কীল

চাকুরি পাবার জন্য সফট স্কীল কিভাবে কাজে লাগেঃ  

কারিগরি দক্ষতা ও বিষয় ভিত্তিক জানাশোনার পাশাপাশি যে দক্ষতাগুলো নিয়োগকারী চাকুরী প্রার্থীর মাঝে দেখতে চান- সেগুলোকেই আমরা সহায়ক দক্ষতা বা চাকুরী পাবার দক্ষতা বলতে পারি। প্রতিটি চাকুরীর জন্য কারিগরি দক্ষতার পাশাপাশি বিশেষ কিছু দক্ষতা চাওয়া হয়। এছাড়াও সব ধরনের চাকুরীর সাফল্যের জন্য বিশেষ কিছু দক্ষতার প্রয়োজন হয়। এগুলোকেই সফট স্কীল বা সহায়ক দক্ষতা বা চাকুরী পাবার দক্ষতা বলে। এই দক্ষতাগুলো চাকুরী পেতে, চাকুরী করতে এবং চাকুরীতে উন্নতি করতে অবশ্যই প্রয়োজন।

প্রথমত, আপনি ভাবুন, পাঁচ হাজার প্রার্থীর লিখিত পরীক্ষা নিয়ে মৌখিক পরীক্ষার জন্য ১০০ জনকে নির্বাচিত করা হয়েছে। তাদের মাঝ থেকে ১০/১৫/২০ জনকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হবে।

কিংবা, দুই হাজার প্রার্থীর মধ্য থেকে রেজাল্ট, বিষয় সম্পৃক্ততা, ইত্যাদি দেখে ৫০ জনকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করা হয়েছে মৌখিক পরীক্ষার জন্য। তার মধ্যে ৫ জনকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হবে।

অথবা,  আইবিএ-এর মাধ্যমে লিখিত পরীক্ষা নিয়ে ১০ জনকে নির্বাচিত করা হয়েছে। তার মধ্যে ১/২ জনকে নেওয়া হবে।

দ্বিতীয়ত, ধরে নিন, এই সবকটি ক্ষেত্রেই আপনি সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীদের একজন।

আপনি এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কি কি বিষয় বিবেচনায় আনবেন?

পড়াশুনার বিষয় সম্পৃক্ততা, রেজাল্ট, লিখিত পরীক্ষার ফলাফল, যেখান থেকে পড়াশুনা করেছে তার খ্যাতি, ইত্যাদি। মজার বিষয় হচ্ছে উপরোক্ত মানদন্ডে  নির্বাচিতদের মাঝে থেকে চূড়ান্তভাবে  নেওয়া বা না নেওয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া খুবই কঠিন। কিন্তু আপনাকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করতে হবে। তখন আপনি একটু ভিন্নভাবে ভাবতে শুরু করবেন। আপনি ভাববেন ভবিষ্যতে কাজের পরিবেশে চাকুরি প্রার্থী প্রতিষ্ঠানের দেয়া দায়িত্ব পালন করতে পারবেন কিনা?

আপনি চিন্তা করবেন, যে কাজের জন্য নেওয়া হচ্ছে তা করতে পারবে কিনা? কথা গুছিয়ে বলতে পারে কিনা? ভাল লিখতে পারে কিনা? অন্যদের সাথে মিলে মিশে কাজ করতে পারবে? কাজ করাতে তদারকি কতটুকু করা লাগবে? বিশ্বস্ত হওয়া প্রয়োজন, হিসেব নিকাশ কেমন পারে? কম্পিউটারে দক্ষতা কেমন, গ্রাহককে সন্তুষ্ট করতে পারবে? ধৈর্য কেমন? শেখার আগ্রহ কেমন? দায়িত্ব নিতে চাইবে কিনা?

মোট কথা আপনি ভাবুন আপনার সাথে এক বা একাধিক লোক কাজ করলে তাদের মাঝে আপনি কি কি দক্ষতা দেখতে চান। এই ভাবনা শেষে আপনি যে উত্তরগুলো পাবেন, তার সবকটিই সফট স্কীল সহায়ক দক্ষতা বা চাকুরী পাবার দক্ষতা।

এবার আপনি আপনার আসল জায়গায় চলে আসুন। আপনি একজন চাকুরী প্রার্থী।  আপনি কি করবেন? আপনাকে জানতে হবে, কারিগরি দক্ষতার পাশাপাশি আর কি কি দক্ষতার উপর ভিত্তি করে প্রার্থী নির্বাচন নির্ভর করার সম্ভাবনা আছে। কিভাবে আপনি তার মধ্যে অধিক গুরুত্বপূর্ণগুলো অর্জন করতে পারবেন?

একটি চাকুরীতে আবেদনের জন্য বিজ্ঞাপিত পদের জন্য  যে শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয় তা থাকলেই আমরা আবেদন করি।সরকারী প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্ব-শাসিত প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ইত্যাদিতে শিক্ষাগত যোগ্যতাকে  প্রধান নিয়ামক হিসেবে দেখা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষার পর সাক্ষাৎকার নেয়া হয় প্রার্থী নির্বাচনের জন্য। কিছু প্রতিষ্ঠান নতুন চাকুরেদের, আর কিছু প্রতিষ্ঠান অভিজ্ঞদের শুধুমাত্র সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে নির্বাচিত করে।

লিখিত পরীক্ষায় দেখা হয়  কারিগরি দক্ষতা সাধারণ কিছু দক্ষতা যা সহজেই পরিমাপ করা যায়। লেখার দক্ষতা (সহায়ক দক্ষতার মধ্যে পড়ে) এবং প্রাথমিক হিসেব নিকাশের দক্ষতা সাধারণত যাচাই করা হয়। সাম্প্রতিক বিষয়ে জানাশোনা –  যাচাইয়ের আরেকটি জনপ্রিয় বিষয়।

প্রার্থীর জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও ঘটনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বের করার চেষ্টা করা হয় প্রার্থীর প্রয়োজনীয় সফট স্কীল বা সহায়ক দক্ষতা আছে কিনা। এ প্রক্রিয়া আপেক্ষাকৃত জটিল। অনেকে এসেসম্যান্ট সেন্টারের  মাধ্যমে এ কাজটি করে থাকে।

নির্দিষ্ট পদের জন্য প্রয়োজনীয় হার্ড স্কীলের পাশাপাশি সফট স্কীল থাকলে চাকুরি জীবনে সেই ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের জন্য বেশি লাভ নিয়ে আসতে পারেন বলে বিশ্বাস করা হয়।

তাই চাকুরি পাবার জন্য সফট স্কীল বা সহায়ক দক্ষতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

চাকুরিতে সফট স্কীল

চাকুরি পাবার পর সফট স্কীল কিভাবে কাজে লাগেঃ  

চাকুরীর আবেদনের সময় আমরা সাধারণত কারিগরি দক্ষতা বা হার্ড স্কীলের দিকেই নজর দেই বেশি।প্রতিটি কাজের জন্য যে মৌলিক কিছু দক্ষতার প্রয়োজন হয় তাই কারিগরি দক্ষতা। আপনি কোন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেলে সে দক্ষতাগুলো আপনার থাকবে এবং দিন দিন তা শাণিত হবে-এটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা।

চাকুরি পাবার পর সফট স্কীলের বা সহায়ক দক্ষতার দিকে আমাদের মনোযোগ কম থাকে। অথচ চাকুরীতে ভাল করার জন্য সফট স্কীলের গুরুত্ব বেড়েই চলছে দিন দিন। প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে একজন কর্মীকে সহকর্মী, ক্রেতা, সেবা গ্রহণকারী, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা সহ অনেকের সাথে কাজ করতে হয়। এই ধরণের বহুমাত্রিক পরিবেশে কাজে সাফল্য লাভ করতে সফট স্কীলে  দক্ষতা অপরিহার্য।

আপনি টিমে সাধারণ সদস্য হিসেবে কাজ করতে জানতে হবে। দলনেতা হলে আপনার লিডারশীপ ও ইমোশোনাল ইন্টালিজেন্স লাগবে। আমরা সব সময় কোন না কোনা সমস্যার মুখোমুখি হই। এক্ষেত্রে প্রবলেম সলভিং স্কীল লাগবে। প্রযুক্তি ছাড়া এখন জীবন অসম্ভব। তাই প্রযুক্তির দক্ষতাও আপনার লাগবে। অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্বায়নের এই যুগে বিভিন্ন জাতি, গোত্র, ধর্মের লোকের সাথে কাজ করতে হবে। এইক্ষেত্রে গ্লোবাল স্কীল দরকার। আপনার বক্তব্য অন্যকে ভালভাবে বোঝাতে হবে। অন্যের বক্তব্য ভাল করে বুঝে নিতে হবে। এক্ষেত্রে যোগাযোগের দক্ষতা ও ইন্টারপার্সোনাল রিলেশন খুব দরকার। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনার সফলতা কোন না কোন সফট স্কীলের উপর নির্ভরশীল।

সেক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি পেশাজীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সফট স্কীলের গুরুত্ব দিন দিন বেড়েই চলছে।

বিভিন্ন ধরণের সফট স্কীলঃ

আপনাদের সুবিধার জন্য বেশ কিছু সফট স্কীলের নাম নীচে দেওয়া হল –

১) কমিউনিকেশান স্কীল বা যোগাযোগের দক্ষতা
২) পজিটিভ এটিটুড বা যথাযথ মনোভাব/প্রবণতা
৩) লিডারশীপ বা নেতৃত্বের দক্ষতা
৪) টিম ওয়ার্ক বা দলবদ্ধভাবে কাজ করার দক্ষতা
৫) প্রবলেম সলভিং স্কীল বা সমস্যা সমাধানের দক্ষতা
৬) ইমশোনাল ইন্টালিজেন্স বা আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা
৭) ইনেশিইয়েটিভ ও এন্টারপ্রাইজ বা উদ্যোগ গ্রহণ ও কিছু শুরু করার দক্ষতা
৮) প্ল্যানিং ও অরগানাইজিং বা পরিকল্পনা ও সংগঠন
৯) সেলফ ম্যানেজমেন্ট বা স্ব-ব্যবস্থাপনা
১০) লার্নিং স্কীল বা শেখার দক্ষতা
১২) ডিজিটাল স্কীল/ টেকনোলজিক্যাল স্কীল বা প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা
১৩) কর্মাশিয়াল এওয়ারনেস বা  বাণিজ্যিক সচেতনতা
১৪)  ফ্লিক্সিবিলিটি/রেজিলিনেন্স বা নমনীয়তা
১৫)  গ্লোবাল স্কীল বা বৈশ্বিক দক্ষতা
১৬) নেগোসিয়েশান ও পারসুয়েডিং বা দরকষাকষি ও বোঝানোর দক্ষতা
১৭) নুমেরেসি বা সংখ্যাতাত্ত্বিক জ্ঞান
১৮) সেলফ এওয়ারনেস বা আত্ম-সচেতনতা
১৯) পারসোনাল ইমপ্যাক্ট বা ব্যক্তিগত প্রভাব
২০) স্ট্রেস টলারেন্স বা চাপ সহনশীলতা
২১) ইন্টেগ্রিটি বা শুদ্ধতা
২২) ইনডিপেনডেন্স স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা
২৩) ডেভলাপিং প্রফেশনালিজম বা পেশাদারিত্ব অর্জন করা
২৪) একশান প্ল্যান বা কর্ম-পরিকল্পনা
২৫) ডিসিশান মেকিং বা সিন্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা
২৬) ইণ্টারপারসোনাল সেনসিটিভিটি বা আন্তঃব্যক্তিগত সংবেদনশীলতা
২৭) ক্রিটিক্যাল থিংকিং সমালোচনামূলক চিন্তা ও ক্রিয়েটিভিটি বা সৃজনশীলতা
২৮) প্রেজেন্টাশান স্কীল বা উপস্থাপনার দক্ষতা
২৯) এনালিটিক্স বা উপাত্তের পরিসংখ্যান
৩০) পারসিভারেন্স ও মোটিভেশান বা অধ্যবসায় ও প্রনোদনা
৩১) ওয়ার্ক ভ্যালু বা কাজের মূল্যবোধ
৩২) প্রিভিয়াস এক্সপেরিয়েন্স এন্ড নলেজ বা অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান
৩৩) লয়েলিটি বা বিশ্বস্ততা
বিভিন্ন ধরণের দক্ষতা নিয়ে জানতে “দক্ষতার প্রাথমিক আলোচনা” এই লেখাটি পড়তে পারেন।

পরবর্তীতে আমরা গুরুত্বপূর্ণ সফট স্কীল অর্জনের উপায় সর্ম্পকে লেখা নিয়ে আসব।