দক্ষতার ধারণা
আমাদের জন্মগ্রহণ থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত আমরা জানা-অজানায় নানা রকম দক্ষতা অর্জন করি এবং সেগুলো দিয়ে আমাদের জীবনের ও জীবিকার বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করে আমরা সামনে এগিয়ে যাই।
শৈশব থেকে শুরু করে পড়াশুনা শেষ করা পর্যন্ত দক্ষতা সম্পর্কে তেমন গুছানো চিন্তা-ভাবনা আমরা করিনা। অভিবাবক-শিক্ষকরা নানাভাবে আমাদের পরিচালিত করেন।
কিন্তু যখন জীবিকার প্রশ্ন সামনে চলে আসে, তখন আমাদের কঠিন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয়। চাকুরিতে প্রতিযোগী বেশি কিন্তু চাকুরি কম। আবার উদ্যোগতাদের ঝুঁকি অনেক বেশি। তাই জীবিকার যে কোন দিকেই দক্ষতার প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ঠিক এই সময়টাতে আমরা বিভিন্ন দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি এবং তা অর্জনের চেষ্টা করি। যারা কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জনে সফল হন, তার দ্রুত সফলতা লাভ করেন।
বিভিন্ন ধরণের দক্ষতা আমাদের পেশাগত, সামাজিক, ও ব্যক্তি জীবনে কাজে লাগে। কিছু দক্ষতা আমাদের সব ধরণের পরিস্থিতিতে কাজে লাগে। আর কিছু দক্ষতা নির্দিষ্ট পরিবেশ পরিস্থিতিতে কাজে লাগে। এই লেখায় আমরা বিভিন্ন ধরণের দক্ষতা শ্রেনীবিন্যাস নিয়ে একটা প্রাথমিক ধারনা দেওয়ার চেষ্টা করবো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, একই দক্ষতা বিভিন্ন শ্রেনীভুক্ত করা যায়।
এবার আমরা জানার চেষ্টা করি, দক্ষতা বলতে কি বোঝায়?
নির্দিষ্ট সময় ও সম্পদ ব্যবহার করে কোন কাজে প্রত্যাশিত ফলাফল পাবার সামর্থ্য হচ্ছে দক্ষতা।
নিজে কয়েক প্রকার দক্ষতার কথা উল্লেখ্য করা হলঃ
১) হার্ড স্কীল বা পেশা ভিত্তিক দক্ষতা
২) সফট স্কীল বা সহায়ক দক্ষতা
৩) টেকনিক্যাল স্কীল বা কারিগরি দক্ষতা
৪) এমপ্লোয়বিলিটি স্কীল বা চাকুরি পাবার দক্ষতা
৫) পারসোনাল স্কীল বা ব্যক্তিগত দক্ষতা
৬) হাইব্রিড স্কীল বা সমন্বিত দক্ষতা
৭) লাইফ স্কীল বা জীবন যাপনের দক্ষতা
এইবার আমরা এই দক্ষতাগুলোর প্রাথমিক পরিচয় পাওয়ার চেষ্টা করবো একে একে।
হার্ড স্কীল বা পেশা ভিত্তিক দক্ষতাঃ
একটি নির্দিষ্ট কাজ বা জব সীমিত সময় ও সম্পদ ব্যবহার সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে যেসব দক্ষতার প্রয়োজন হয় সেগুলো সেই কাজের জন্য হার্ডস্কীল বা পেশাগত দক্ষতা। হার্ডস্কীলের দখলই কোন পেশায় আপনার পারদর্শিতার মাত্রা নির্দেশ করবে। হার্ডস্কীল নির্দিষ্ট কাজ বা পেশা বা জব ভিত্তিক। চাকুরির বিজ্ঞাপনে ও জব ডেসক্রিপশনে হার্ডস্কীল বা পেশাগত দক্ষতার উল্লেখ্য থাকে। পেশাগত দক্ষতা আমরা প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জন করতে পারি। যেমনঃ
ক) স্কুল, কলেজ, ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা
খ) প্রশিক্ষণ
গ) শিক্ষানবীশকাল
ঘ) ইন্টার্ণশীপ
ঙ) অনলাইন কোর্স
চ) পেশাদার সার্টিফিকেশান বা ডিগ্রি
ছ) চাকুরিকালীন প্রশিক্ষণ বা অন দ্যা জব ট্রেনিং
নির্দিষ্ট জ্ঞান ও দক্ষতা যা কোন কাজে সাফল্যের জন্য অবশ্যই প্রয়োজন তাই হার্ড স্কীল বা পেশাগত দক্ষতা।
হার্ডস্কীল শেখা যায়, ব্যাখ্যা করা যায় বা সংজ্ঞায়িত করা যায়, মূল্যায়ন করা যায় এবং পরিমাপ করা যায়।
হার্ড স্কীল নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ও সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় এক প্রার্থীর সাথে আরেক প্রার্থীর তুলনার জনপ্রিয় ও কার্যকর উপায়।
চাকুরিজীবনে বিভিন্নভাবে আমাদের পেশাগত দক্ষতা যাচাই করা হয়। ঘাটতি থাকলে তা ঠিক করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
হার্ডস্কীল বা পেশাগত দক্ষতার উপর ভিত্তি করেই আমাদের পদন্নোতি ও ট্রান্সফার হয়।
বিভিন্ন পেশায় নিম্নে উল্লেখিত হার্ডস্কীলগুলো লাগেঃ
১) একাউন্টিং
২) প্রশাসনিক
৩) এনালিটিক্স বা উপাত্তের পরিসংখ্যান
৪) অডিটিং
৫) অটোমোটিভ টেকনোলজি
৬) ব্যাংকিং অপারেশন
৭) বুক কিপিং
৮) বাজেটিং
৯) নির্মাণকাজ
১০) কার্পেন্ট্রি
১১) ডাটাবেইজ ম্যানেজমেন্ট
১২) ডিজাইন
১৩) এডিটিং
১৩) ইলেক্ট্রিক্যাল
১৪)ইঞ্জিনিয়ারিং
১৫) অর্থবিদ্যা
১৬) হার্ডওয়্যার
১৭) স্বাস্থ্য
১৮) প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ
১৯) বিভিন্ন ভাষা
২০) আইন সর্ম্পকিত
২১) উৎপাদন প্রযুক্তি
২২) মার্কেটিং রিসার্চ বা বিপণন গবেষণা
২৩) কারিগরি
২৪) মেডিক্যাল ডায়াগনসিস
২৫) নার্সিং
২৬) অপ্টিমাইজেশান
২৭) ফার্মাসিটিক্যাল কোডিং
২৮) পাইপ ফিটিং
২৯) প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট
৩০) প্রপোজাল রাইটিং
৩১) রিপোর্টিং
৩২) বিজ্ঞান
৩৩) সফটওয়্যার
৩৪) মার্কেটিং ও সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং
৩৫) স্প্রেডশীট
৩৬) শিক্ষকতা
৩৭) টেকনিক্যাল রাইটিং
৩৮) টেস্টিং
৩৯) অনুবাদ
৪০) ট্রান্সক্রিপশান
৪১) ওয়ার্ড প্রসেসিং, ইত্যাদি।
সফট স্কীল বা সহায়ক দক্ষতাঃ
এই দক্ষতা কারিগরি দক্ষতাও না, আবার পেশা নির্দিষ্ট দক্ষতাও না। একটি কাজ কীভাবে করবেন, কাজের পরিবেশে অন্যদের সাথে আপনার সর্ম্পক কীভাবে নির্ধারিত হবে, কি ধরণের আচরণে আপনি দলে কাজ করতে পারবেন বা দলকে পরিচালিত করতে পারবেন, কীভাবে অন্যদের সমস্যা ও সুবিধা আপনি অনুভব করতে পারবেন এবং কীভাবে আপনি কোন সমস্যার সমাধান করবেন। এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে আপনি যা যা পাবেন তাই সফট স্কীল বা সহায়ক দক্ষতা।
এই দক্ষতাগুলো পুনঃ ব্যবহারযোগ্য দক্ষতা। বিভিন্ন ধরণের কাজে এই দক্ষতাগুলো লাগে। যাদের সফট স্কীল থাকে, তারা খুব দ্রুত যে কোন কর্ম পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
বিভিন্ন সফট স্কীল বা সহায়ক দক্ষতার নামঃ
১) অভিযোজন
২) যোগাযোগের দক্ষতা
৩) সৃজনশীল চিন্তা
৪) নির্ভরতা
৫) কর্মনীতিকতা বা ওয়ার্ক এথিকস
৬) পজিটিভিটি
৭)টিম ওয়ার্ক
৮) সময় ব্যবস্থাপনা
৯) প্রেষণা বা মোটিভেশান
১০) সমস্যা সমাধানের দক্ষতা
১১) ক্রিটিক্যাল থিংকিং
১২) ইমোশনাল ইন্টালিজেন্স
১৩) দ্বন্দ নিরসনের দক্ষতা,ইত্যাদি
সফট স্কীল বা সহায়ক দক্ষতা মূলত কর্ম পরিবেশে মানুষের সাথে মানুষের সুস্থ্য সর্ম্পক বজায়ে রাখার ও মানুষকে সঠিককভাবে পরিচালিত করার যে গুণাবলি তারই সমন্বয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই দক্ষতা অর্জন করা যায়না। বিভিন্ন কর্ম পরিবেশে নিজের সহকর্মীদের সাথে কাজ করতে করতে সফট স্কীল বা সহায়ক দক্ষতা অর্জন করা যায়। এই শিক্ষণ প্রক্রিয়ার অন্যদের প্রতিক্রিয়া ও গ্রহণযোগ্যতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুতীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ আমাদের সফট স্কীল অর্জনে সহায়তা করে।
টেকনিক্যাল স্কীল বা কারিগরি দক্ষতাঃ
এই দক্ষতা সমূহ মূলত হার্ডস্কীল বা পেশাগত দক্ষতার মাঝেই পড়ে।একটি নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করার জন্য যে জ্ঞান ও দক্ষতা লাগে তাই টেকনিক্যাল স্কীল। এটি একেবারেই প্রায়োগিক দক্ষতা। জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, ও সামর্থ্যের সমন্বয়ে এই দক্ষতা গড়ে উঠে।
কারিগরি বা মেকানিক্যাল, তথ্য প্রযুক্তি, গাণিতিক, ও বিজ্ঞানভিত্তিক হার্ডস্কীলগুলোকে আমরা টেকনিক্যাল স্কীল হিসেবে দলভুক্ত করি। তবে এই দক্ষতাগুলো একেবারেই নির্দিষ্ট কাজে ব্যবহৃত হয়। এদের ট্রান্সফারেবিলিটি বা পুনঃ ব্যবহার যোগ্যতা খুবই কম।
বিভিন্ন টেকনিক্যাল স্কীল বা কারিগরি দক্ষতার নামঃ
১) বিগ ডাটা
২) উপাত্তের পরিসংখ্যান
৩) ডাটা মাইনিং
৪) ডাটা বেইজ ডিজাইন
৫) ডাটা বেইজ ম্যানেজমেন্ট
৬) কোয়ান্টিটিটিভ রিসার্চ
৭) কোয়ান্টিটিটিভ রিপোর্ট, ইত্যাদি।
এমপ্লোয়বিলিটি স্কীল বা চাকুরি পাবার দক্ষতাঃ
এই দক্ষতা সমূহ আলাদা কোন দক্ষতা নয়। হার্ড স্কীল সফট স্কীল ও টেকনিক্যাল স্কীল নিয়েই এমপ্লোয়বিলিটি স্কিল। এই স্কীল জব বা কাজের উপর নির্ভর করে। যে পদের জন্য আবেদন করবেন বিজ্ঞাপনে বা জব ডেস্ক্রিপশানে যে হার্ড স্কীল ও টেকনিক্যাল স্কীল উল্লেখ্য করা থাকে তা থাকতেই হবে। সফট স্কীলের কথা উল্লেখ্য থাকলে, উল্লেখিত হার্ড বা টেকনিক্যাল স্কীল যদি অনেকের মাঝে থাকে, তাহলে প্রয়োজনীয় সফট স্কীলের দক্ষতা আপনাকে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনেক এগিয়ে দেবে।
আপনি কোন ধরণের পদের জন্য আবেদন করছেন, তার উপর এমপ্লোয়বিলিটি স্কিলসেট নির্ভর করে। এন্ট্রি লেভেল পজিশনের জন্য টেকনিক্যাল স্কীলের গুরুত্ব অনেক বেশি, মিড লেভেল বা ব্যবস্থাপক পর্যায়ের জন্য টেকনিক্যাল স্কীল ও হিউম্যান রিলেশান স্কীল- দু’টোই গুরুত্বপূর্ণ। টপ লেভেল বা লিডারশীপ পজিশনে কনসেপচুয়াল স্কীল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
পারসোনাল স্কীল বা ব্যক্তিগত দক্ষতাঃ
আপনার শারিরীক ও মানসিক সুস্থ্যতার জন্য যে দক্ষতাগুলো প্রয়োজন সেগুলোই পারসোনাল স্কীল। স্থিতিস্থাপকতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মসচেতনতা, চাপ ও রাগ সহনশীলতা।
হাইব্রিড স্কীলঃ
এই স্কীল্টি হার্ড স্কীল ও সফট স্কীলের সমন্বয়ে গড়ে উঠে। প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ ও পরিবর্তনের ফলে হাইব্রিড স্কীলের চাহিদা বেড়ে চলছে। যেমনঃ প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট একটি সফট। সফটওয়্যার ডিজাইন ও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট হার্ড স্কীল বা টেকনিক্যাল স্কীল। আইসিটি সর্ম্পকিত কোন প্রজেক্টে সফটওয়্যার ডিজাইন, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টের সমন্বয়ে হাইব্রিড স্কীল প্রয়োজন।
লাইফ স্কীল বা জীবন যাপনের দক্ষতাঃ
সুস্থ্য, সুন্দর, ও সামাজিক জীবন যাপনের জন্য আমাদের যে দক্ষতাগুলো লাগে, সেগুলোই লাইফ স্কীল। আমাদের জীবনে কাজে লাগে এমন যে কোন দক্ষতাই লাইফ স্কীল। জুতার ফিতা বাঁধা থেকে শুরু করে সাঁতার কাটা, ড্রাইভিং করা, হিসাবনিকাশ করা, কম্পিউটার চালানো সবই লাইফ স্কীলের মধ্যে পড়ে।
বৃহৎ পরিসরে বলতে গেলে জীবনের চ্যালেঞ্জগুলোকে সুবিধাজনক ও কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার দক্ষতাই লাইফস্কীল। পরিবেশ পরিস্থিতি, ও আর্থসামাজিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে একেক জন মানুষের একেক ধরণের লাইফস্কীল প্রয়োজন।
বান্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লাইফ স্কীল ঢাকা থেকে ভিন্ন। আবার ঢাকার লাইফ স্কীল নিউইয়র্ক বা টোকিও থেকে ভিন্ন। তাই লাইফ স্কীলের তালিকা করে শেষ করা সম্ভব নয়।
হার্ড স্কীল, সফট স্কীল, টেকনিক্যাল স্কীল, পার্সোনাল স্কীল , হাইব্রিড স্কীল – সব দক্ষতাই লাইফ স্কীলের মধ্যে পড়ে।
মৌলিক লাইফ স্কীলের মধ্যে আছে –
ক) শেখার দক্ষতা
খ) স্বাক্ষরতা
গ) হিসাব করার দক্ষতা
ঘ) সাইকেল চালানো/ সাঁতার কাটা/ ড্রাইভিং
ঙ) রান্না
চ) ধৈর্য্য
ছ) পড়ার দক্ষতা
জ) যোগাযোগের দক্ষতা, ইত্যাদি
বাকীগুলো অন্যান্য দক্ষতার মাঝে চলে আসে।
এই হলো বিভিন্ন দক্ষতা নিয়ে আমাদের সাধারণ আলোচনা। পরে বিভিন্ন দক্ষতার বিস্তারিত নিয়ে হাজির হব আপনাদের কাছে।
বিভিন্ন ধরণের দক্ষতা উন্নয়নে দেখুন URQUERY TRAINING.
সফট স্কীল নিয়ে জানতে “সফট স্কীলের প্রয়োজনীয়তা” লেখাটি পড়তে পারেন।
এই ডিজিটাল সময়ে আমাদের কি কি করা উচিত কি কি করা উচিত না জানতে চাইলে পড়ুন “ডিজিটাল লিটারেসি”
That is a very nice article. thanks for share this.
Pingback: চাকুরি পাবার জন্য ও চাকুরি জীবনে সফট স্কীলের প্রয়োজনীয়তা | Songshoptok
Pingback: ডিজিটাল লিটারেসি | Songshoptok