২০০৭ সালের শেষের দিকে আমি ঢাকা আসি। শেওড়াপাড়ায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন মিলে একটি বাসায় থাকি। ২০০৮ সালের শেষে ভাবলাম, চট্টগ্রাম থেকে আনা আমার বড় বড় কার্টুনে দেখতে হবে কি কি আছে? অপ্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র সব ফেলে দিতে হবে। একটা একটা করে দেখি। কিছু বাতিল করি, কিছু রেখে দেই। ক্লাস নোটস, টার্ম এর ব্যাখ্যার খাতা, ইত্যাদি দেখছি। আর মাঝে স্মৃতি রোমস্থন করে হাসছি। এক একটা বই, খাতা, টুকরো কাগজের স্মৃতি চলমান ছবির মত ভেসে উঠছে মনে। ক্যাম্পাস, শাটল, চট্টগ্রাম শহরের অলিগলি মনে পড়ে যাচ্ছে।

হাতে উঠে এল, একটা রাবার(গার্ডার) দিয়ে মুড়ে রাখা কয়েকটা কাগজ। রাবার সরিয়ে পেলাম আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ভ্যালেন্টাইন ডে তে পাওয়া দুটি চিঠি আর একটি কবিতা। চিঠি দু’টোতে দুই বান্ধবীর ভ্যালেন্টাইন শুভেচ্ছা, সুন্দর জীবন কামনা। পড়ে ভাল লাগল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ হবার পর আর তাদের সাথে দেখা হয়নি। কি অমলিন স্মৃতি!

এবার কবিতা পড়া শুরু করলাম। ইংরেজিতে লেখা। বার বার পড়লাম। বুঝতে চেষ্টা করছি।  যা এখন বুঝেছি, তা কি ঠিক আছে? না, যা আগে বুঝেছিলাম তা ঠিক আছে?

যখন কবিতাটি হাতে পেয়েছিলাম, পড়েছি কয়েকবার। আমার ইংরেজির দখল দূর্বল থাকাতে অত ভাল করে বুঝিনি। মনে হয়েছে বন্ধুর প্রতি আবেগ প্রকাশিত হয়েছে সে কবিতায়। ভাল লেগেছিল অনেক। এই প্রথম আমার উদ্দেশ্য কারো কবিতা লেখা।

কিন্তু সাত বছর পরে পড়ে মনে হচ্ছে, প্রতিটি লাইনে তীব্র আবেগ আছে। সম্পর্কটাকে বন্ধুত্ব থেকে অন্যদিকে নেওয়া প্রচ্ছন্ন ইচ্ছাও আছে।

আমি বোঝা ও না বোঝার দোলাচালে দুলছি!

ধরে নিন তার নাম “রেহনুমা”। তার সাথে প্রথম পরিচয় ডিপার্টমেন্টে আমাদের ব্যাচমেটদের মাঝে সেশন জ্যাম নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আমি আমার মত প্রকাশ করেছি। সেও করেছে। সেদিন আমি তাকে প্রথম খেয়াল করি।

একদিন ক্লাসে যেতে যেতে দেরী হয়ে গেল। উঁকি দিয়ে ক্লাসে কোন সিট ফাঁকা দেখা যাচ্ছেনা। স্যার আমাকে দেখে ফেল্লেন।

  • এই ছেলে, উঁকি দিচ্ছ কেন? ভেতরে এসে বস।

আমি ঢুকে কোথাও বসার জায়গা পাচ্ছিনা। তারপর দেখি শুধু একটা বেঞ্চে তিনজন বসেছে। বাকী সবগুলোতে চারজন করে। তিন জনের বেঞ্চে তিনজনই মেয়ে। তার মাঝে একজন রেহনুমা।

স্যার আবার বলে উঠলেন, দাঁড়িয়ে কেন, বসে যাও।

আমি  রেহনুমার কাছে গিয়ে আস্তে করে বল্লাম, মনে কর আমিও বেঞ্চের কাঠ।

সে ফিক করে হেসে বলল, বসে যা!

আমি বসে গেলাম।

তারপর থেকে কথা শুরু।

সে সিরিয়াস কিসিমের মানুষ, পড়াশুনা নিয়েই কথা হয়।

ভার্সিটি খোলার দিন, অনেকে মিলে পড়ি।

শুক্রবারে ঝুপড়িতে গিয়ে পড়াশুনা হয়।

তখন সাধারণত আমরা দু’জনই থাকতাম আমাদের গ্রুপের।

আমাদের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় আট মাসের জন্য বন্ধ ছিল।

তখন মাঝে মাঝে তার শহরের বাসায়ও গিয়েছি বেশ কয়েকবার। পড়াশুনা ছাড়া আমার সাথে সে কোন বিষয়ে কথা বলেছে খুব কম। তবে আমি চা খেতে পছন্দ করি। সেটা জানত। চা বানিয়ে খাওয়াতো প্রতিবার বাসায় গেলে।

তার সাথে শর্ত ছিল রোদ বা বৃষ্টিতে সে আমাকে ছাতা ধরে নিয়ে যাবে। আমার ছাতা ধরে রাখতে বিরক্ত লাগতো। সে তাই করতো।

একদিন বৃষ্টি ছিল, ছাতা ছিল শুধু আমার কাছে। তাকে ছাতা দিয়ে হল পর্যন্ত দিয়ে চলে আসব, এমন সময় দেখি চারদিকে প্রচুর গোলাপ বিক্রি হচ্ছে। সবাই সবাইকে গোলাপ দিচ্ছে। আমিও লাল গোলাপ কিনে রেহনুমাকে দিলাম। সে ভীষণ লজ্জা পেয়ে হলের দিকে দৌড় লাগালো। আমি একদম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। দৌড় দেওয়াতে সবাই সবাইকে জিজ্ঞেস করতে লাগল, “ কে দৌড় দিল? কেন দিল?”

আমি এবার নাই! লেডিস হলের দিকে আমি যেতাম না। যাওয়ার পর কি অবস্থা!!

তারপর আমি অনেক কিছুতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। আন্দোলন, ক্লাস, টিউশনি, ইত্যাদি। তার সাথে আস্তে আস্তে যোগাযোগটা ফিকে হয়ে আসল। আমার মাথায় কখনো আসেনি আমার প্রতি তার কোন অনুরাগ তৈরি হতে পারে। তাই সেটা নিয়ে ভাবিনি।

দেখতে সুন্দর, পড়াশুনায় ভাল, গুছানো একজন মানুষ। তার লেভেলের মানুষ আমার প্রতি দূর্বল এটা আমার চিন্তায় আসেনি।

তাই সাত বছর যখন আমার ইংরেজি তার কবিতা বোঝার মত সবল হয়েছে, তখন তা আমাকে দোদূল্যমান আবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পর তার সাথে আমার  কখনো দেখা হয়নি।

এই ২০২০ সালে এসেও আমি ভাবি কবিতার মানেটা আসলে কি ছিল!