টিপটিপ করে ক্লিনিকের পেছনের ট্যাপটা থেকে পানি পড়ছে নর্দমায়,
যেন খাঁ খাঁ রোদ্দুরে শ্রান্ত কুকুরের মতো জিহ্বা ঝুলিয়ে
যান্ত্রিক নগরটা লালা ঝরিয়ে জিরিয়ে নিচ্ছে।
ধূলোপড়া কর্কশ ধূসর ইঁটের দেয়ালে আবদ্ধ প্রাণগুলো
আগুনে পোড়া পাখাহীন পতঙ্গের মতো দাপিয়ে মরছে;
জংধরা ছোপছোপ বাদামী টিনের চালায় একটা কাক
একপায়ে কি যেন চেপে ধরে ধারালো চঞ্চু দিয়ে ছেঁড়ার চেষ্টায় মগ্ন।
আর আমি, গলির বাস্তুহীন কুকুরটা, নর্দমার পাশে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত লেজ নাড়ছি,
নর্দমার জলে ভেসে আসা ছোট্ট অপরিণত একটা শরীর আবর্জনার স্তুপে আটকা পড়েছে;
স্তুপের চুড়ায় বসে আর একটা কাক তার ছোট্ট চোখদুটো অসীম আক্রোশে ঠুকরে চলেছে।
‘ঘেউ’ করে উঠতেই উড়ে গেল কাকটা।
কে জানে কার ঘরে অযাচিত অতিথি হয়ে এসেছিলে!
মায়াচ্ছাদিত পৃথিবীর ভ্রমসুখ আস্বাদনে কিসের এতো তাড়া?
তুমি তো যীশুদেব নও; কুমারী মা তোমার জন্মলগ্নে হবেনা দেবদূতের আশীর্বাদপুষ্ট।
তাই সুদর্শন এলোমেলো যুবকের ছলনায় ভুলে তোমাকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল যে মেয়েটি,
দায় দু’জনের হলেও কলঙ্ক যে তার একার;
অতঃপর মাঝপথেই তোমায় ফিরিয়ে দিয়েছে।
অন্ধকার গহ্বরে ভয়ে জড়সড় তোমায়
যার কন্ঠ করেছিল আশ্বস্ত, আবছা হাতের পরশ,
চেয়েছিলে চোখ মেলেই প্রাণভরে তার মুখটা দেখতে,
কিন্তু বড্ড অসময়ে এসে পড়েছিলে,
ছোট্ট সংসারটা সাজানো হয়নি তখনও,
ছোঁয়া হয়নি যে সাফল্যের চূড়ো,
দ্বিধাগ্রস্ত মনে তাই অদেখা মনোবিক্ষেপের বিসর্জন।
আর যেখানে খুশির জোয়ার এনেছিল তোমার আগমনী বার্তা,
বেডরুম আর লিভিংরুম জুড়ে খেলনা, ন্যপি, জনসনে ঠাসা,
বিশ্বাসঘাতক ওই যন্ত্রটি প্রকাশ করে দিল তোমার লজ্জাস্থানের রহস্য।
সবার চোখেমুখে ঘনকালো মেঘের ঘনঘটা,
তোমার গর্ভধারিনীর আকুতি যে যথেষ্ট ছিলনা।
অনিশ্চয়তা আর রক্তচক্ষুর কাছে শেষ মুহূর্তে তাই মাতৃসত্ত্বার আত্মসমর্পণ।
কেমন করেই বা করতো সাহস?
দিনে দুপুরে শ্বাপদ, হায়েনারা যে কিশোরীর শরীরে তান্ডব চালালো,
মাতৃত্বের তিক্ত ধারা তার শিরায়, ধমনীতে পাশবিক জ্বালা ধরায়;
অক্টোপাসের সাঁড়াশী দিয়ে আঁকড়ে ধরে তার সর্বাঙ্গ,
কন্ঠরোধ হয়; উদর চিড়ে উগরে ফেলা হয় ছোট্ট নিরিহ, নিষ্পাপ ‘হারামজাদা’
এই ভালো; কাক আর শকুনের দ্বন্দ্বটুকু সয়ে নাও,
তারপর ফিরে যেও তোমার ‘প্রতিশ্রুত’ আবাসে।
ঈশ্বরকে কোন প্রশ্ন করোনা,
কেননা ঈশ্বরদের কোন জবাবদিহিতা থাকেনা।
লেখক পরিচিতি
সোহানা খাতুন একজন লেখক ও পেশাদার অনুবাদক। জন্ম জয়পুরহাটে। শৈশব আর কৈশোর কেটেছে দিনাজপুর আর জয়পুরহাট মিলিয়ে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে TESOL-এ দ্বিতীয় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপর বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ বিজনেস এন্ড টেকনোলজি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ও নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশে পূর্ণ ও খণ্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি ফ্রিল্যান্সার অনুবাদক, পাঠ উপকরণ পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষক হিসেবে ব্রিটিশ কাউন্সিল, আইএল ও এবং অন্যান্য এনজিও সংস্থার সাথে যুক্ত আছেন।