বছরখানেক অফিস আর বাসা করতে করতে মোটামুটি আমি যখন ক্লান্ত-বিরক্ত, তখন সিদ্ধান্ত নিলাম এই ভয়ংকর রুটিন থেকে আমার বের হতেই হবে। কিন্তু আমার পতি-মহাশয়ের তো সময় নেই! রাগ করে বললাম, “তুমি গেলেও যাব, না গেলেও যাব। দরকার পড়লে একাই যাব।” সে বোধহয় একটু ভয়ই পেল। জিজ্ঞেস করলো, “কই যাব?”
আমার আবার পাহাড় পছন্দ, ছোটবেলা কেটেছে চিটাগং-এ। যারা এই অঞ্চলে থেকেছে, তারা জানে পাহাড়ের রূপ কতোটা সুন্দর। বছরের শুরুর সময়টাও পাহাড়ে চড়ার জন্য বেশ ভালো। সোনায়-সোহাগাহলো যখন দেখলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বন্ধু-বান্ধবও গ্রুপ করে পাহাড়ে যাবার মতলব করছে। আমার ওনাকে বললাম, সেইদিকেই যাব। উনার আবার সমুদ্র পছন্দ। পরে গাই-গুই করে ঠিকই রাজি হলো। জায়গা হিসেবে ঠিক হলো, দেবতাখুম, বান্দরবান।
গ্রুপের সবাই চাকুরীজীবি, সংখ্যায় সাতজন। তাই বেরানোও হবে একদিনের জন্য। বৃহস্পতিবার অফিস করে রাতের গাড়িতে রওনা দিয়ে, পরদিন সারাদিন ঘুরেফিরে রাতের গাড়িতে আবার ঢাকায়। শীতকাল বলে একেবারে গরম জামা-কাপড় বেশি করে পরেই বের হলাম বাসা থেকে। অফিস শেষে সবাই ফকিরাপুল বাসস্ট্যান্ডে শ্যামলী এন, আর ট্রাভেলস এর সামনে আসলাম। যাই হোক, গাড়ি অল্প একটু দেরিতে ছাড়লো। একে রাতের বেলা, তার ওপর শীত, আর আমি গাড়িতে উঠলেই ঘুমাই। কানে হেডফোন দিয়ে, কানটুপি আর গরম কাপড় আরও টেনে নিজেকে নিদ্রা দেবীর হাতে তুলে দিলাম। মাঝে একটা বিরতি দিয়ে আবার ঘুমালাম।
ভোরে চোখ খুলে বাসের জানালা দিয়ে যা দেখলাম তাতেই আমার সারা রাতের ক্লান্তি দুর হয়ে গেল। বাস কখনো পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠে, তো কখনো সোজা খাড়া পাহাড় বেয়ে নিচে নামে। যতদুর চোখ যাবে, সবুজ ছাড়া কিছু দেখা যায় না। হঠাৎ ঢাকা থেকে বান্দরবান গেলে বেহেস্ত খুব বেশি দুরে না মনে হতেই পারে। খুব ভোরে বাস বান্দরবন পৌঁছালো। আমরা সেখানকার এক হোটেলে নাস্তা সেরে বের হয়েই দেখি, আমাদের নিতে গাইড আর চান্দের গাড়ি তৈরি।
আমি আগে কখনো বান্দরবনে যাইনি, চান্দেরগাড়িতেও উঠিনি। চান্দের গাড়ি দেখেই ভালো লাগছিলো। গ্রুপে আমি একমাত্র মেয়ে, বলতে গেলে ভি আই পি হিসেবে আমাকে গোনা হচ্ছিলো! সাতটা নাগাদ চান্দেরগাড়ি ছাড়লো, আর আমরাও টের পেলাম শীত কাকে বলে। একেকজনের চুল, দাঁড়ি বেয়ে শীতের শিশির বিন্দু বিন্দু করে ঝরে পড়ছিলো। শীত কমাতে কয়েকজন ধরলো গান। গানগুলো আসলেই জাদুর মতো কাজ করলো, অবশ্য ততক্ষণে রোদও উঠা শুরু হয়েছে। সেই উচুঁ-নিচু রাস্তা, সাথে চান্দেরগাড়ির গতি। মাঝে মাঝে ছোট ঝিরিপথ দিয়ে নেমে আসা পানি। কোথাও রাস্তার দু’পাশে উঁচু পাহাড়, তো কোথাও দু’পাশেই বিশাল বড় বড় খাড়ি। একটু অসাবধান হলেই সবাই সত্যিকারের বেহেস্তবাসি হয়ে যাব। কোথাও কিছু ঘর-বাড়ি, তো কোথাও মন্দির। সত্যি বলতে একবারের জন্যেও চোখ বন্ধ করতে ইচ্ছে হবেনা, মনে হবে, চোখ বন্ধ তো মিস। লোকজন রোদ পোহানো শুরু করে দিয়েছিল। আমরা প্রথমে থানায় গিয়ে নিজেদের নাম-ঠিকানা, আইডির ফটোকপি জমা দিলাম। এটা বান্দরবন বেড়াতে গেলে সবারই করতে হয়। তারপর, আসল গন্তব্যের দিকে রওনা দিলাম। নয়টা নাগাদ কচ্ছপতলি পৌঁছে আবার আর্মি ক্যাম্পে নাম-ঠিকানা, আইডির ফটোকপি জমা দিয়ে ট্রেইল ধরে হাঁটা শুরু করলাম। প্রথমে অবাক লাগছিলো, এমন পাহাড়ের গা বেয়ে কখনো হাঁটিনি। পরে মনে হচ্ছিল পা পিছলে পড়লে হাড়ও ভাঙবে, মান-সম্মানও যাবে। তাই মন দিয়ে, চোখ বড় বড় করে হাঁটছিলাম। কোথাও কোথাও নিজের অজান্তেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলাম।
ভাবছিলাম, সবকিছু এতো সুন্দর হয়? দু’পাশে পাহাড়, মাঝে অনেকদুরের নাম না জানা কোন ঝর্নার পানি বয়ে যাচ্ছে, কিছু জায়গায় পাহাড়ের গা বেয়েও ছোট ছোট ঝিরি থেকে পানি নেমে আসছিল। কি পরিষ্কার, টলটলে সেই পানি। কোথাও পানি গোড়ালি পর্যন্ত, কোথাও বা হাঁটুর উপরে। বর্ষায় নাকি পানি অনেক বেড়ে যায়। যাই হোক, প্রায় এক ঘন্টা হেঁটে একটা আদিবাসীদের গ্রামে পৌছালাম। সেখানে পানি পানের বিরতি দিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। মাঝে একটা দোকান থেকে লাইফ জ্যাকেট নিয়ে কিছুদূর গিয়ে নৌকায় চড়ে বসলাম। গ্রুপের একজন তখনি পানিতে লাফিয়ে পড়ে সাঁতার দিতে থাকলো। আমার জন্য আর একটা ভয়ের ব্যাপার হলো, আমি সাঁতার জানি না।যদিও পানিতে ডুবে যাবার অভিজ্ঞতা আমার অনেক বেশি বলে পানির ভয় আমার একেবারেই নাই হয়ে গেছে। আধা ঘন্টা পর নৌকা থেকে নেমে ভেলায় করে যেতে হয় বাকিটুকু। বেশিরভাগ ভেলায় একজনের বেশি উঠা যায়না। কিন্তু আমার ভেলা চালানোর পূর্ব- অভিজ্ঞতা না থাকায় আমাকে গাইড এর সাথেই উঠতে হলো। অবশ্য, রাজি হতামনা যদি না তার একটু আগে একা ভেলা চালাতে যেয়ে ব্যালেন্স হারিয়ে পানিতে পড়ে না যেতাম। হঠাৎ ভেলায় উঠে আপনার মনে হতেই পারে যে আপনি টুক করে অন্য এক জগতে চলে এসেছেন। কারণ, যান্ত্রিক জগতের কোন শব্দ এখানে পৌঁছায় না। শুধুমাত্র দুয়েকটা পাখির ডাক, আর ভেলার ভেসে চলার শব্দ। এমনকি পাহাড় চুইয়ে পড়া পানি যখন খুমের পানিতে মিশে সেই শব্দও সহজেই শুনা যায়। নিরবতা যদি পছন্দ না হয়ে থাকে তবে এই নিরবতা যে কারো মনে ভয় সৃষ্টি করতে পারে। সাথে খুমের গভীর পানির ভয়ংকর সৌন্দর্য্য যে কাউকে বিহবল করে দিতে পারে। একজন গান ধরলো, “ওরে নীল দরিয়া”, যদিও এটা খুম, এবং এর পানিও সবুজ। অবশ্য মনে আনন্দ থাকলে সবই গাওয়া যায়। পৌনে এক ঘন্টার মতো ভেলা চালানোর পর আমরা খুমের প্রথম ধাপে এসে পৌঁছাই। এরপর বাকিটুকু যেতে হলে বর্ষার জন্য অপেক্ষা করতে হবে, কারণ পানির উচ্চতা তখন সর্বোচ্চ থাকে। যাইহোক, আমরা সেখানে যার যার ইচ্ছেমতো পা ভিজিয়ে, গোসল করে, ফটোসেশান করে আবার ফিরতি পথ ধরলাম। ভেলা আর নৌকা পাড়ি দিতেই প্রায় দুপুর, সূর্য পুরো মাথার উপরে। শুরু হলো হাঁটা। আসার সময় ঝিরির পানি সকালের চাইতে বেশি ছিল বলে, গাইড আমার জন্য পানির পথ যথাসম্ভব বাদ দিয়ে পাহাড়ী পথে আনার চেষ্টা করলো। যতক্ষণে আবার কচ্ছপতলি ফিরেছি সবাই মোটামুটি ক্লান্ত আর ক্ষুদায় কাতর। বাজারের কাছে পিঠে খুব বেশি বড় খাবারের দোকান নেই, তাই এক ছোট দোকান থেকে পেঁপে আর শশা খেয়ে গাড়ীতে উঠে বসলাম। প্রায় একঘন্টা গাড়ী যাত্রা শেষে একটা খাবারের দোকানে দুপুরের খাবার খেলাম সবাই। হাতে তখনো অনেক সময়, ফেরার বাস রাত ১১টা ১৫ মিনিটে। সবাই মিলে ঠিক করলো বিকেলটা নীলগিরিতে কাটানো হবে। সময়ও পার হবে, আবার বেড়ানোও হবে। চান্দের গাড়ীতে ঘুমানো এমনিতেই কঠিন, তার উপর রাস্তা যদি পাহাড়ী হয় তো কথাই নেই। তবে আমার জন্য সেসব কোন ব্যাপারই না। দুই ঘন্টার রাস্তার দেড় ঘন্টাই ঘুমিয়েছিলাম। সত্যি কথা হলো, অনেক বেশি ক্লান্ত ছিলাম। ঘুম ভাঙার পর শুনলাম নীলগিরির কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। দেখলাম গাড়ী শুধু পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। যত গাড়ী উপরে উঠছিল, নিচের সব কিছু ছোট লাগছিল। একসময় গাড়ী থামলো। রাস্তার দু’পাশে লাইন করে দাঁড়ানো গাড়ীর সারি। দেবতাখুম বলতে গেলে একা একাই বেড়ানো গেলেও নীলগিরির অবস্থা পুরোই ভিন্ন। এখানে মানুষ আর মানুষ। টিকিট কেটে ভেতরে যেয়ে বুঝলাম আমরা শহরের সবচেয়ে উঁচু জায়গাগুলোর একটায় আছি। বিকেলের ঝলমলে আলো তখন আর কষ্ট দিচ্ছিলনা। সোনালী আলো দেখতে দেখতেই গোধুলিতে রুপ নিচ্ছিল। আমরা সূর্য ডোবা দেখে আবার গাড়িতে চড়ে বসলাম। সকালে যে হোটেলে নাস্তা করেছিলাম সেখানেই আবার আসলাম। রাতের খাবার খেয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে করতে জানলাম, হোটেল এর গ্রাউন্ড ফ্লোরে লাইভ মিউজিক শো চলছে। গিয়ে দেখি সেখানে অডিয়েন্সের রিকোয়েস্টের গানও গেয়ে যাচ্ছেন গায়ক। আমাদের আর কি লাগে? পেট ভরে খাবারের পর আবার পছন্দের গানও শুনা। দেখতে দেখতে গাড়ির সময় হয়ে গেল। টেরও পাইনি সারাদিন কি করে কেটে গেল। ফেরার পথে মনে হচ্ছিল কোন ক্লান্তি নেই শরীরে। শুধু মনে হচ্ছিল, আবার কবে ফিরব? নাহ্, পাহাড়ে একটা কুঁড়েঘর আমার লাগবেই!