কোরবাণী ঈদের দিন। ভেবেছিলাম সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে আটটার জামাতে ঈদের নামাজ পড়ে কোরবাণীর কাজ শেষ করবো। সাড়ে ছয়টায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। ছুটির দিনে সকালে ঘুম ভাঙবেই। অফিস থাকলে এলার্মের শব্দেও ঘুম ভাঙতে চায় না। সব ঘুম তখন চোখ জুড়ে ভর করে।

এপাশ ওপাশ করে ওঠে গেলাম। মনে হল নীচে কোরবাণী দেওয়ার আয়োজন শুরু হচ্ছে। লোকজনের কথা, ব্যস্ত পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। অবাক হলাম। এই বিল্ডিংয়ে এত তাড়াতাড়ি গরু জবাই শুরু হয়না!

ভাবলাম নিচে গিয়ে দেখি কি অবস্থা। নিচে গেলাম।

দারোয়ান কালাম বলল, “স্যার আপনাদের গরু জবা করা শ্যাষ!

বিল্ডিংয়ের সামনে গিয়ে দেখি, আমার এক অংশীদার সহাস্য বদনে জবাই করা গরুর পাশে দাঁড়িয়ে তদারকি করছেন।

আমাকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে  বললেন, “ ভাই আপনি কই ছিলেন? আমি ছয়টার জামাতে নামাজ পড়ে এসে, হুজুর এনে গরু কোরবাণী দিয়েছি। ভাল করেছি না?”

– জ্বি, ভাল করেছেন।

আমি বাসায় ফিরে যাচ্ছি হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা করার জন্য। নাস্তা করে নামাজে যাওয়া যাবে।  ভাবলাম, সবার গরুগুলো দেখে যাই। একেবারে কোনায় গিয়ে একটা গরু দেখে খটকা লাগল।

রহিম নামে এক দারোয়ানের খোঁজ করলাম। কালাম জানালো সে বেইজমেন্টে আছে। আমি তাকে ডেকে নিয়ে আসতে বল্লাম।

রহিম আসার পর তার কাছে কাছে জানতে চাইলাম,

“এইটা কাদের গরু?”

রহিম জানালো, “আপনাদের।”

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “রাজ্জাক ভাই তাইলে কোনটা জবাই করালো?”

কালাম – স্যার আপনাগোটা সামনে জবা করা!

রহিম – স্যার এডাই আপনাগো!

আমি আবার জবাই করা গরু দেখতে গেলাম।

দেখতে আমাদেরটার মতই। তবে একটু ছোট মনে হচ্ছে!

এবার রহিমকে নিয়ে রাজ্জাক ভাইয়ের কাছে গেলাম।

-ভাই, আপনি কাদের গরু কোরবানী দিয়েছেন?

-আমাদেরটা!

-আমাদেরটাতো ঐ কোনায় দাঁড়িয়ে আছে।

-কি যে বলেন! আমি রাতে যেখানে রেখে গেছি সেখান থেকে গরু এনে কোরবাণী দিলাম।

আমি এবার রহিমের দিকে তাকিয়ে আছি।

রহিম এবার বলতে শুরু করলো, “রাজ্জাক ছার, রাইতে বিষ্টি আওয়াতে আপনাগো গরু না ভিজার লাইগ্যা কোনায় নিয়া রাখছি।”

রাজ্জাক ভাই অবাক হয়ে বললেন, “ আমি যেইটা আনলাম, সেইটা কার?”

-স্যার, সেইটা আনিস স্যারের।

-এইটা তুমি কি বল্লা? গরুর জায়গা পাল্টাইছ্‌ আমারে বলবা না?

-স্যার, আপনিত কাউরে কিছু না কয়ে গরু নিয়ে জবাই দিয়া দিলেন।

-তুমি এইটা কোন কথা বল্লা! তোমার কোন দায়িত্ব নাই! চল দেখিত তুমি কি বলতাছো!

আমরা সবাই গেলাম কোনার গরু দেখতে। রাজ্জাক ভাই এবার চিৎকার ইয়ে উঠলেন, “এইত, আমাদের গরু! তুমি এইটা কি করলা, রহিম! আমি আমাদের বড় গরু রেখে আরেকজনের ছোট গরু জবাই দিয়ে দিলাম। গরু ভিজলে কি হইত। এক রাতেরই ব্যাপার ছিল।”

-স্যার আপনেইত বল্লেন বিষ্টি আসলে গরু কোনায় নিয়া রাখতে।

-তুমি আমারে জানাবা না!

-রাত তিনটার সময় রাখছি। আমি কি বুচ্ছি আপনে না দেইখ্যা কোরবাণী দিয়া দিবেন।

-এখন আমি আনিস সাহেবেরে কীভাবে বুঝাবো, এত ছোট গরুর মাংস হবে কট্টুক!

এত শোরগোল শুনে রাজ্জাক সাহেবের বড় ভাইয়ের ছেলে আসলেন। উনাকে পুরো ঘটনা বুঝিয়ে বলা হল। উনি এবার চাচাকে বোঝাতে লাগলেন কীভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়।

একজনকে পাশের মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে পাঠানো হল। সবাই অপেক্ষায় আছে। এমন সময় আনিস সাহেব নামাজ পড়ে আসলেন। আসার সময় দেখেন, উনার গরু জবাই হয়ে গেছে।

উনাকে ডেকে বিস্তারিত বলা হল।

এমন সময় ইমাম সাহেবের কাছে যাকে পাঠানো হয়েছিল, সে ফিরে এসেছে। সে জানালো গরু যেটা কোরবাণী হয়েছে যাদের নামে সেটা পাল্টানো যাবেনা। যেটা বাকী আছে সেটা অন্যদের নামে দিতে হবে। পাওনা-দেনা থাকলে এখনই মিটিয়ে ফেলতে হবে।

আনিস সাহেব রাজী হলেন। উনি বাড়তি টাকা মিটিয়ে দিয়ে গরু যেটা বাকী আছে সেটা কোরবাণী দিবেন।

রাজ্জাক সাহেব এবার অদ্ভূত এক প্রস্তাব রাখলেন, “ আনিস ভাই, আপনি এই গরু কোরবাণী দেন। কিন্তু মাংস আপনি আপনারটাই নিবেন। টাকা পয়সার আর লেনদেনের কোন দরকার নাই।”

আনিস সাহেব এবার মুখ খুললেন, “ ভাই এইটা কি বলেন? ভুল করলেন আপনারা, ঈমাম সাহেব একটা সমাধান দিলেন, আপনি তাও মানতে চাননা। এবার আমি যদি বলি, আমার গরু ফিরায়ে দেন, তখন আপনি কি করবেন?”

-না আপনার কথা ঠিক আছে, তাও যদি আমার কথাটা বিবেচনা করতেন!

এবার রাজ্জাক সাহেবের চাচা এগিয়ে এসে বল্লেন, “রাজ্জাক শুধু তুমি বল্লেত হবেনা! অন্য শরীকদেরও মতামত নাও।”

রাজ্জাক সাহেব ইশারায় আমাকে ডেকে এক কোনায় নিয়ে গেলেন।

বল্লেন, “ভাই কি করব?”

-ইমাম সাহেব যেটা বলেছেন সেটাই যৌক্তিক। আমরা সেটাই করি।

-বেশি টাকা দিয়ে বড় গরু কিনলাম, এখনত কম মাংস নিয়ে বাসায় যাওয়া লাগবে।

-গরুর কি হয়েছে, বাসায় বলার দরকার নেই। চুপচাপ থাকবেন। মাংস ভাল হবে। খেয়ে দেখবেন ভাবী প্রশংসা করবেন! শুধু গরু পাল্টানোর বিষয়টা বাসায় চেপে যাবেন।

-আচ্ছা। তাইলে আপনারা সবাই যেটা ভাল মনে করেন, সেটাই হবে।

এবার আনিস সাহেব বাড়তি টাকা বাসা থেকে এনে রাজ্জাক সাহেবকে বুঝিয়ে দিয়ে উনার গরু কোরবাণী শেষ করলেন।

মাংস ভাগ করার সময় আমি আবার রাজ্জাক সাহেবকে আশ্বস্ত করলাম মাংস ভাল হবে।

কোরবাণীর দু/তিন দিন পর হঠাৎ রাজ্জাক সাহেবের সাথে দেখা। উনি খুব হাসি হাসি মুখ করে জানালেন, বাসায় মাংস খুব পছন্দ করেছে!