সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, যেসবের মাধ্যমে আমরা অতিসহজেই একে অপরের খুব কাছাকাছি হয়ে যাই এবং খুব দ্রুত তথ্য আদান-প্রদান করতে পারি।দূর দূরান্তে অবস্থিত বন্ধু-বান্ধবী, আত্নীয় স্বজন সবার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারি, তাদের সাথে কথা বলতে পারি,আড্ডা দিতে পারি।দূরত্ব বলে যেন আর কিছুই নেই, এই সোসাল মিডিয়াগুলোর কল্যাণে।
সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর যাত্রা বেশিদিনের নয়।কিন্তু খুব দ্রুতই বিশ্বব্যাপি এর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছে।ফেসবুক,টুইটার,ইনস্টাগ্রাম সহ আরো কিছু জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ ওয়েব সাইট আজ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপি। যেগুলোর ব্যবহার আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যোগাযোগের দূরত্ব কমানো, আর কাছের মানুষগুলোকে আরো কাছে আনাতে যেন সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর জুড়ি নেই।
৫০০ কিমি দূরে অবস্থিত বন্ধুদের সাথে রাতভর আড্ডা,দেশের বাহিরের প্রবাসী ভাইয়ের সাথে ভিডিও কলে খোশ গল্প… দূরত্ব যেন আজ কিছুই না!আচ্ছা, সোশ্যাল মিডিয়াগুলো কি সত্যিই আমাদের মাঝে সবার দূরত্ব কমাচ্ছে? সত্যিই কি সমাজিকতা বাড়াচ্ছে?সত্যিই কি আমাদের মাঝে সম্পর্কের আন্তরিকতা বাড়াচ্ছে?
আমি বলবো “না”। আন্তরিকতা বাড়াচ্ছেনা বরং আন্তরিকতার বোধ কমাচ্ছে।আমার এই “না” বলার যথেষ্ট কারণ আছে।
সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের মাঝে যোগাযোগ দূরত্ব কমালেও আদতে আমাদের সামাজিক দূরত্ব ও আত্মীক দূরত্ব বাড়াচ্ছে!আমাদের চারিপাশের জগৎটাকে যন্ত্রনির্ভর করে ফেলছে, সম্পর্কগুলোও যেন যান্ত্রিক হয়ে গেছে! সেই আন্তরিকতা, ভালোবাসা, মায়া-মমতা, শ্রদ্ধা এসব যেন হারিয়ে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার নীল জগতের আগমনে।সম্পর্কগুলো এখন লম্বা ফ্রেন্ডলিস্টে লিপিবদ্ধ করা। সোশ্যাল মিডিয়ার রঙিন ঝলকানিতে হারিয়ে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়ে আব্বুর সাথে গত ১ মাস যাবৎ আড্ডা দেয়া হয়নি।মনে পরে আম্মুর কণ্ঠে গান শোনা হয়নি সেই কতদিন যাবৎ। আমার সময় কই? নতুন নতুন বন্ধু-বান্ধব; তাদের সাথে ভয়েস চ্যাট, ভিডিও চ্যাট আর গ্রুপ আড্ডায় হারিয়ে গেছি। দুই ভাই রুমে বসে আছি,আমি আমার ফোনে মুখ গুজে বসে আছি আর সে তার ফোনে। আমাদের আড্ডা দেয়ার সময় কই? আমরাতো সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গিয়ে সামাজিক দূরত্ব কমাতে ব্যস্ত! আগে নানু বাড়ি যাওয়ার কথা উঠলে খুশির অন্ত থাকতোনা!ছোট মামার সাথে সন্ধ্যে বেলায় ভুতের গল্প আর সকালে নানুর সাথে হাঁটতে যাওয়া! কই সেসব?গ্রামে নেটওয়ার্ক দূর্বল, নেই ওয়াইফাই কানেকশন। তাই আর ইচ্ছে জাগেনা নানু বাড়ি যাওয়ার! ইচ্ছে করেনা ছোট মামার ভুতের গল্প শোনার, ব্লগ ঘাটলেই সেসব পাওয়া যায় অনেক। মেসেঞ্জারে টুং শব্দে ঘুম ভাঙে আমাদের, সকালে হাঁটতে যাওয়ার সময় কই, ভাই? একসাথে খেতে বসা আর হয়না কতদিন!কিভাবেইবা বসবো? সবার শেষে খাবার টেবিলে বসে এক হাতে মোবাইল আর অন্যে হাতে খাবার, দৃষ্টি খাবারের দিকে না গিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে আটকে যায়। আর যদিওবা এক সাথে খাবার টেবিলে বসা হয়; কোনোভাবে খাবার শেষে করে উঠে পড়তে পারলে বাঁচি,কতগুলো যে নোটিফিকেশন আসলো কে জানে!পাশের বাড়ির প্রতিবেশি চাচা হার্ট এটাক করেছেন গত দুই দিন হলো,উনার ছেলের ফেসবুক পোষ্ট না দেখলে হয়ত জানতামই না সেই খবর। এগুলো কি সামাজিক দূরত্ব বাড়াচ্ছেনা?
এলাকার কয়জন মানুষকে আমরা চিনি? কয়জনইবা আমাকে চেনে?আর চিনবেইবা কিভাবে? কখনো কি তাদের সাথে কথা বলেছি?কুশল বিনিময় হয়েছে কখনো?আগেকার সময় ছোটরা বড়দের দেখলে এগিয়ে যেত, সালাম দিত, কুশল বিনিময় করত, ভালো পরামর্শ নিতো, এক সাথে খেলাধুলা, সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ করার উদ্দ্যেগ গ্রহন করত, পরামর্শ নিতো।এখন বড়দের দেখার সময় নেই! এসব করার ও সময় নেই।যে যার মতো। এখন বড়দের সাথে দেখা হলে ভাই রাতে নক দিবোনি, বাই…।
আমাদের মধ্যে অনেকে কথা বলতে পারিনা কারো সাথে, হয় সংকোচ হয়, নতুবা লজ্জা পায় বা ইতস্তত বোধ করে।কেন এমনটা হবে?সেই ছেলেমেয়েগুলোই তো সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রিয়মুখ সবার।
একটা ছোট্ট গল্প বলি। বগুড়া থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম। অনেক লম্বা একটা জার্নি।পাশের সিটে ৫০-৫৫ বছর বয়সী এক আংকেল বসেছেন।আমি কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছি।খেয়াল করলাম আংকেল বার বার জানালার দিকে তাকাচ্ছেন আর মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাচ্ছেন, কেমন যেন অস্বস্তি অস্বস্তি একটা ভাব।মনে হলো উনার সাথে একটু কথা বলি।হেডফোন খুলে উনার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বললাম। কথা বলার পর জানলাম উনি লম্বা জার্নি তেমন একটা করেন না একা একা! উনার খুবই একা একা লাগছে।আর কথা বলার মতোও কাউকে পান না। যে যার মতো কানে তার গুজে (হেডফোন) দিয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকে।
যাই হোক, উনার সাথে অনেক গল্প হলো, অনেক কিছু জানলাম, শিখলামও অনেক কিছু।দিন শেষে নতুন একটা মানুষের সাথে পরিচিত হলাম এটাই পাওয়া! আঙ্কেল নেমে যাওয়ার সময় উনার নাম্বারও দিয়ে গেলেন, যেন কখনো তার এলাকায় গেলে উনার সাথে দেখা করি! খুবই ভালো লাগলো।আমি অনেকবার বগুড়া টু চট্টগ্রাম আর চট্টগ্রাম টু বগুড়া জার্নি করেছি,এতোটা লম্বা পথ নিয়মিত জার্নি করেও বলতে পারবোনা আমার পাশের যাত্রীটা কে ছিল বা আমার পাশের যাত্রীও বলতে পারবেনা আমি কে ছিলাম!কারন আমরা তো সামাজিক দূরত্ব কমানোর জন্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে একটিভ ছিলাম। ১২ ঘন্টা যাত্রা পথে পাশের সিটে বসা যাত্রীর সাথে কথা বলার সময় কই? আর ইচ্ছেটাই বা কই?
ছোটবেলায় আব্বুর সাথে যখন কোথাও বাসে চড়ে যেতাম, পাশের যাত্রী সাথে কত কথাই না হতো, এমনও হইছে পাশের যাত্রী আদর করে স্টপেজে জোর করে লজেন্স পর্যন্ত কিনে দিয়েছে। আজ সেই আন্তরিকতা নেই।
আমরা যান্ত্রিক হয়ে গেছি।আমাদের অনুভুতিগুলো সোশ্যাল মিডিয়ার সেই হলুদ হলুদ ছোট্ট ইমোজি গুলোতে বন্দি হয়ে গেছে, সেসবের মাধ্যেমেই অনুভুতি গুলো আজ প্রকাশ পায়।
আমাদের এসব যান্ত্রিকতা নিয়ে অনেক মনোবিজ্ঞানীরা অনেক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছেন, সেসব ফিরিস্তি না হয় অন্যে কোনদিন দিব।
পরিশেষে একটাই কথা বলবো, সোসাল মিডিয়ায় সামাজিকতা রক্ষা করতে গিয়ে যেন বাস্তব জীবনে অসামাজিক না হয়ে যাই।আমাদের যান্ত্রিক সামাজিকতার কারণে যেন আশেপাশের মানুষগুলোকে একাকিত্বের মাঝে ফেলে না দেই।