আমি স্কুল কাটিয়েছি শহরতলিতে। মফস্বল শহর বললে ইজ্জত একটু বাড়ে।

ক্লাস সেভেনে যখন পড়ি তখন প্রথম আলো মাদকবিরোধী একটি স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ঢাকায়। আমি বিতর্ক করেছি তা বললে আমি নিজেই লজ্জা পাই।  প্রধান শিক্ষকের ব্যক্তিগত আগ্রহে এবং তত্ত্বাবধানে আমিসহ ক্লাস এইটের আরো দুইজন আপু প্রস্তুতি নিয়ে চললাম ঢাকায়। আমাদের দেখেশুনে রাখার জন্য সঙ্গে স্কুলের একজন শিক্ষক। 

দুই দিনের অনুষ্ঠানের প্রথম দিন মাদকবিরোধী কথাবার্তা, দ্বিতীয় দিন বিতর্ক।জানানোর লোভ সামলাতে পারছি না যে ঐ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় আমরা প্রথম সেমিফাইনালে সিলেটের ব্লুবার্ড স্কুলের কাছে হেরেছিলাম যারা পরবর্তীতে চ্যাম্পিয়ন হয়। 

ঢাকায় ঐ প্রোগ্রামে এসে আমার চিন্তা ও দেখার জগত এলোমেলো হয়ে গেলো।  মঞ্চে তাকালেই চোখে পড়ে শুভেচ্ছার উপস্থাপক তুষারকে!

একের পর এক দেখা যাচ্ছে নোবেল, অপি করিম, আইয়ুব বাচ্চু, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাসহ চেনা অচেনা কত তারকা! আমার মনে হতে লাগলো ঢাকায় রাস্তায় সবসময়ই এসব তারকাদের দেখা মেলে। আর মিলবে না কেন? উনারা তো সবাই ঢাকায় থাকেন।

ঐ প্রোগ্রামের অনেক স্মৃতির মধ্যে সবচেয়ে গভীরভাবে দাগ কাটলো অপি করিম! কি তার হাসি, সরলতা, মায়ামাখা মুখ!                    

তার পর কেটে গেল কয়েক বছর।

সময়টা ২০০৫। সদ্য এসএসসি পাশ করে ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হলাম। নটরডেম কলেজে ভর্তির চাপা গর্ব, একা ঢাকায় থাকার উত্তেজনা, পুরোনো বন্ধুবান্ধবদের ছেড়ে আসার ভোঁতা ব্যাথা সব মিলিয়ে একেবারেই ভিন্ন একটা মানসিক অবস্থা।

৫১বর্তী , ব্যাচেলর ইত্যাদি নাটকে অপি করিমকে দেখে কিশোর বয়সের ভালোলাগা (নাকি মোহ!) তখন তুঙ্গে।  আরামবাগের মেস আর নটরডেমের ক্লাসরুম পর্যন্ত সীমাবদ্ধ আমার ঢাকার জীবন। আমার খুব মনে হতো হঠাৎই একদিন  অপি করিমের সাথে দেখা হয়ে যাবে। আরামবাগের গলিতে হাঁটতে হাঁটতে আমি কখনোই ঠিক করতে পারতাম না অপির সাথে দেখা হলে আমি কি বলবো! নিজের সাথে নিজের প্রায়ই দ্বন্দ্ব হতো প্রথমে কি বলা ঠিক হবে! বিটিভির লাল গোলাপ টকশোতে দেখা “লাইফ ইজ বিউটিফুল” মুভির নায়ক নায়িকার প্রথম দেখা হওয়ার সে নাটকীয় দৃশ্যগুলো সব সময়ই মনে থাকতো আর উৎকণ্ঠাকে বাড়িয়ে দিতো।

ক্রমেই আমার কাছে ঢাকার আয়তন বড় হলো। অপি বুয়েটে পড়তো মিডিয়া সূত্রে এ খবর জানা ছিলো। একদিন চলে গেলাম বুয়েট। সেদিন প্রবল উত্তেজনায় আমার বিশ্বাস প্রবল হতে লাগলো আজকে অপির সাথে আমার দেখা হবেই! 

সব অনুভূতিই শেষ হয়। আর এ সময়ে নাকি শোকের আয়ু বড়জোর একবছর। যাই হোক ততদিনে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় শেষের দিকে। আমার এক খালা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরি করতেন। মিরপুরে বসবাসকারী খালাতো বোন যখন হাঁপিয়ে উঠতো তখন সে খালার সাথে শহবাগে আসতো আর আমার দায়িত্ব ছিলো তাকে ক্যাম্পাসের তুলনামূলক মুক্ত পরিবেশে  ঘুরাঘুরি করানো। বেশিরভাগ সময়ে চারুকলাতেই আমরা ঘুরতাম। কোনো এক শীতের খানিকটা আগে আমরা চারুকলায় হাঁটছিলাম। চারুকলার মাঝখানে ছোট্ট বৃত্তাকার জলাশয়ে কালো চাদর পরিহিত এক নারীকে খুব চেনা লাগলো। কেবলই মনে হতে লাগলো এতো অনেকটা অপি করিমের মতো দেখতে। অপি তখন উচ্চতর পড়াশোনার জন্য জার্মানিতে! তাই উনি অপি হতে পারেন এ ধারনা বার বার বাদ দিচ্ছিলাম। তবু দূর থেকে দেখছি আর অবাক হচ্ছি। এতোটা মিল কিভাবে হয়। সেই অবয়ব, সেই হাসি!

যাইহোক, মনে হয় তিন দিন পর প্রথম আলোর পাতায় পেলাম অপি কাউকে না জানিয়ে চুপিচুপি এখন ঢাকায়।

হায় আমি!