“লিলিয়া তুমি কিন্তু কিছুই খাচ্ছোনা! মা কিন্তু বিরক্ত হচ্ছি” ম্যাডাম কিছুটা ক্লান্ত সুরে বললেন।

“মা সকালে কিছু খেতে আমার ভালো লাগে না”, বলেই লিলিয়া সমর্থনের আশায় বাবার দিকে তাকালো। বাবা তখন মোবাইলে দিকে তাকিয়ে; সম্ভবত খবরের শিরোনাম দেখছে।

“তাড়াতাড়ি করো!” ম্যাডাম তাগাদা দিচ্ছেন। গাড়ি তখন মানিক মিয়া এভিনিউ পেছনে ফেলেছে। সামনেই লিলিয়ার স্কুল। লিলিয়াকে স্কুলে নামিয়ে গাড়ি যাবে মহাখালি। সেখানে ম্যাডামকে নামিয়ে তারপর মতিঝিলে স্যারের অফিস। বারোটায় স্কুল ছুটি হলে লিলিয়াকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে দুপুরে গোছল, খাওয়া- দাওয়া বিশ্রাম তারপর আবার ম্যাডাম ও স্যারকে অফিস থেকে বাসায় পৌঁছে আশরাফের ছুটি। এই করতে করতে রাত আটটা, কখনো কখনো নয়টাও বেজে যায়।

প্রতিদিনের এ রুটিনে আশরাফ অভ্যস্ত। লিলিয়ার স্কুল সকাল আটটায়। সকালে তাড়াহুড়োর কারনে সকালের নাস্তাটা লিলিয়ার গাড়িতেই করা হয়। ডিম পরোটা আর ফলের শরবত । কখনো কখনো বাসায় তৈরি কেক থাকে। মেয়েটা খেতেই চায় না। তাই প্রতিদিনই ম্যাডামকে বেশ কষ্ট করে লিলিয়াকে নাস্তা শেষ করাতে হয়।

লিলিয়াকে স্কুলে নামানোর পর স্যার বললেন, “মেয়েটার রাত জাগা কমাতে হবে। রাতে দেরি করে ঘুমায় বলেই সকালে দেরি হয়ে যায় আর নাস্তাটা নিয়ে ঝামেলা করতে হয়।” 

“এসব বলে আর কি লাভ? রাতের টকশো, মোবাইল এসব করতে করতেই তো একটা বাজিয়ে ফেলো। কি মজা পাও টিভিতে অর্থহীন বকবক শুনে? আমার কথাতো এভাবে মনোযোগ দিয়ে কখনো শুনোনি। আমাদের ঘুমাতে দেরি হয় বলেই ওর ঘুমাতে দেরি হয়।”

এসব বলতে বলতেই ম্যাডামকে নামানোর সময় হয়। ম্যাডামকে নামানোর পর গাড়িতে নিরবতা নেমে আসে। এসময়টা আশরাফের ভালো লাগে না। সে নিজে কথা না বললেও স্যার, ম্যাডাম, আর লিলিয়ার কথা শুনতে ভালো লাগে। কেমন যেন সুখের একটা ব্যাপার থাকে। আশরাফ লিলিয়াকে নিয়ে স্যার ম্যাডামের আলোচনা বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনে। স্যার ম্যাডাম দু’জনই লিলিয়ার ব্যাপারে বেশ সতর্ক। গাড়িতে আশরাফ ওদের যে আলাপ শুনতে পায় তাতে প্রায় সবসময়ই লিলিয়ার পড়াশোনা, সময় কাটানো, সুস্থতা, ভালো থাকা এসব নিয়েই স্যার ম্যাডামের কথা হয়। লিলিয়া বড় হচ্ছে স্যার ম্যাডামের আদরে, ইংরেজি স্কুলের পড়ায়।

এভাবেই আশরাফ ধীরে ধীরে লিলিয়ার বেড়ে ওঠে দেখে, পূর্ন হওয়া দেখে। 

ভাবতে ভাবতে আশরাফের নিজের চার বছরের ছেলে এরশাদের কথা মনে হয়। ছেলের রংপেন্সিলের বক্সটা এবার ওর জন্য কিনতেই হবে। আশরাফের বাবা হঠাৎ অসুস্হ হয়ে যাওয়াও অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে যাওয়ায় গতমাসে সে এরশাদের রংপেন্সিল বক্স কিনতে পারেনি। ছেলে প্রতি রাতেই মাকে ঐ বক্সের কথা মনে করিয়ে দেয়। লিলিয়ার স্কুলের পাশের দোকানে সে সেদিন একটা বক্স দেখে এসেছে। সঙ্গে নীল মলাটের একটা ছবি আঁকার খাতা। এরশাদ যদিও খাতা চায় নি কিন্তু ঐ খাতাটা পেলে ছেলে কেমন খুশি হবে তা কল্পনা করে আশরাফ তৃপ্তি পায়।

গতকাল রাতে আশরাফের বউ ফোন করে কিছু টাকা বাড়তি চেয়েছে। এরশাদ নাকি কেক খেতে চেয়েছে। বইয়ের পাতায় সে কেকের ছবি দেখেছে। এছাড়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার আপাও নাকি এরশাদকে দেখে তাকে বেশি করে পুষ্টিকর খাবার ও ফলফলাদি খেতে বলেছে। 

নিজের অজান্তেই আশরাফের চোখ ভারী হয়, মনোযোগ নষ্ট হতে চায়। কিন্তু গাড়ি চালানোর সময় মনোযোগ হারানো কিছুতেই চলবে না! নিজেকে সামলে নেয় আশরাফ।