সকালে ক্লাসে যাওয়ার জন্য হিমেল ফজরের নামাজ শেষে তার সদ্য কেনা নতুন মোবাইলে এলার্ম দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। সকাল ৯.২০ এ এলার্ম দিয়েছে ৯.৪৫ এর ট্রেন ধরার জন্য। ক্লাস ছিল ২টা মাত্র। তাই এসময়ে যাওয়া। মোবাইলটি যথারীতি বেজে উঠল। হিমেল চোখ ভরা ঘুম নিয়ে কষ্টের সম্পত্তি হিসেবে পাওয়া মোবাইলটির দিকে তাকিয়ে দেখে আরামের ঘুম আর হবে না। কষ্টের মোবাইল বলছি কারণ- মোবাইলটির পেছনে একটি সুন্দর গল্প লুক্কায়িত আছে।

রমজানে হিমেলের ক্যাম্পাস পুরো মাসের জন্য বন্ধ থাকে। ছেলেটি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান বলে টিউশন করে চলতে হত। তাই সে ইচ্ছা থাকলেও বন্ধের অবসরটুকু প্রিয় পরিবারের সাথে কাটানোর সুযোগ কই! টিউশন মাস্টার হওয়াতে তাই অগত্যা শহরে থেকে যেতে হয়। সেই সুযোগে হিমেল ভাবল বাড়িতে জানবে না, তাই কাপড়ের দোকানে সেলসম্যান হিসেবে কাজ শুরু করে  রমজানে। একটি স্মার্ট ফোন নিবে বলে। পাশাপাশি টিউশন। সকাল ৯টায় দোকানের ডিউটি রাত ২.০০টায় শেষ হত। মাঝখানে ছুটি নিয়ে টিউশনটাও করিয়ে আসত। এভাবেই যায় তার নির্ঘুম একটা মাস। অবশেষে ওই বেতনের টাকায় কিনে মোবাইলটি তার সম্পত্তি বনে গেল।

তো, সেদিন এই মোবাইলের এলার্ম শুনে উঠে, ফ্রেশ হয়ে, ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে, চলে যায় ট্রেন ধরতে। ট্রেন আসতেই দৌড়ে উঠে মোট ছয়টি সিট ধরে রাখে। ছয়টি সিট মানে- ট্রেনের দু’সিটে ছয়জন করে বসে যেতে হয়। কিন্তু ওরা ছিল (সাজ্জাদ, মুনতাছির­, আরিফ, সুবর্ণ আর হিমেল সহ) মোট পাঁচজন। সবাই একে একে বসে পড়ল সিটে।স্বাভাবিকভাবেই একটা সিট খালি। তাই এক ভদ্রলোক এসে জিজ্ঞেস করল বসতে পারবে কিনা (অনুমতি নেবার কারণ চবির শাটলে যে আগে সিট ধরবে তার অধিকারে হয়ে যায় সিটগুলো। তাই অপরিচিত কেউ বসলে অনুমতি নিতে হয় আগে তার থেকে)। হিমেল ভদ্রলোকটির দিকে থাকিয়ে অপ্রয়োজনীয় আসনটা ওনাকে দিয়ে দেয়। 

হিমেল আর ভদ্রলোকটি পাশাপাশি বসল। পরক্ষণেই শাটল তার গর্বের ইয়া বড় ভেঁপুটি বাজিয়ে তার যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রামের ষোলশহর স্টেশন থেকে প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে ভরা আঁকাবাঁকা পথে পাহাড়ে ঘেরা সবুজ ক্যাম্পাসের দিকে ।এদিকে হিমেলরা স্বভাবসুলভ আড্ডাতে মশগুল হয়ে পড়ে। হঠাৎ ভদ্রলোকটি হিমেল থেকে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কোন ডিপার্টমেন্টে পড়ো?” হিমেলরা আড্ডাতে মত্ত থাকার কারণে আবার জিজ্ঞেস করল, “কিছু বলছেন আংকেল?” তিনি আবার বললেন তারা কোন ডিপার্টমেন্টে পড়ে? হিমেল বলল, “আংকেল আমরা সবাই ইংরেজি বিভাগেই পড়ি।” লোকটি প্রশংসা করে বলে, “বাহ! খুব ভাল।” হিমেল এবার নিজের আগ্রহে জিজ্ঞেস করে বসে ওনার পরিচয়টা। লোকটি বলল, “আমি চবির প্রাক্তন ছাত্র। অর্থনীতি বিভাগে পড়ছিলাম। বর্তমানে একটি কলেজে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে অধ্যাপনা করি। শখের বসে  শাটল ট্রেনে চড়া।”

ওনার কথা শুনে হিমেলের অন্য বন্ধুরাও গল্প ছেড়ে আমাদের কথায় মনোযোগী হয়ে যায়। এবার তিনি বললেন, “তোমরা কি সবাই একই এলাকার, না ভিন্ন এলাকার?” সাজ্জাদ বলল,  “ভিন্ন এলাকার। চবিতেই সবাই বন্ধু হলাম।” তখন ভদ্রলোক সবার কলেজের নাম জানতে চাইল, এরপর খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে এলাকা জানতে না চেয়ে স্কুলের নাম জানতে চাইল। সবাই এবার নড়েচড়ে বসল। কারণ স্বাভাবিকভাবেই কোন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রের কাছ থেকে যখন তার উচ্চ বিদ্যালয় সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় তখন তার একটু গর্বিত মনে হয় নিজেকে। কারণ এতদুর আসা একজন ছাত্রের অবশ্যই কোন না কোন দিকে উচ্চ বিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। কারো হয়ত উচ্চ বিদ্যালয় রেজাল্ট ভাল, কারো হয়ত উচ্চ বিদ্যালয়ের কারো বা কোন শিক্ষকের অবদান আছে, এমনি বিভিন্ন দিক।

প্রথমেই সাজ্জাদ বলল- ওর বিদ্যালয় চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। ও ছিল ক্লাসের থার্ড বয়। এস এস সি রেজাল্ট এ প্লাস, ওদের স্কুলের পাশের হার ৯৫% থেকে ১০০%, প্রতিবছর ৫০-৬০ জন গোল্ডেনসহ এ+ পায় ইত্যাদি।

এরপর একে একে মুনতাছির, আরিফ ও সুবর্ণ বলতে লাগল ওদের বিদ্যালয় জীবনের গুণকীর্তন। বলাবাহুল্য­ যে সবার ভাল রেজাল্ট হস্তগত ছিল। এমনকি সবার বিদ্যালয়টিও শহর এলাকায়। বিদ্যালয় ব্যাকগ্রাউন্ডটাও খুব নামকরা। আরিফের যদিও গ্রামে ছিল কিন্তু তাও শহর থেকে কোন অংশে কম না।

এদিকে হিমেল তাদের গুলো শুনতে শুনতে ভাবতে থাকে- ইশ! আমার বিদ্যালয়েতো এতোসব গুণগান নেই। আমার বিদ্যালয়েতো এতো পাশের হার, এ+ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী নেই। কি বলব আমি! ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে সবুজের সমারোহ দেখতে দেখতে হিমেলের বলার পালা চলে আসে। ট্রেন ক্যাম্পাস পৌঁছতে এখনো ২০ মিনিট বাকি।

এবার হিমেল সাহস নিয়ে বলতে শুরু করল নরম সুরে- আমার বিদ্যালয়ের নাম ধোপাছড়ি শীলঘাটা উচ্চ বিদ্যালয়। পাহড়ে পরিবেস্টিত স্কুলটি সাঙ্গু নদের তীরবর্তী এলাকায় প্রতিষ্ঠিত। এলাকাটি একটি দুর্গম এলাকা।অনেক সংগ্রাম করে এলাকার মানুষগুলোর বেড়ে উঠা।পাশের হারের ৮০% এর চাইতেও তার শিক্ষার পরিবেশ যেকোন মানবপ্রেমীর মনকে সহজে আকৃষ্ট করতে বাধ্য।প্রতিবছরের নগন্য এ+ এর শিক্ষার্থীর চাইতেও এই এলাকার হাজারো শিক্ষার্থীর সংগ্রামী ছাত্রজীবন যেকোন এ+ এর শিক্ষার্থীকে হার মানাতে যথেষ্ট। শহরের একটি বিদ্যালয়ের নবম-দশম শ্রেণীর পড়ুয়া একজন ছাত্রকে যেখানে মা-বাবা, ভাইবোন কেউ গিয়ে বিদ্যালয়ে পৌঁছানো থেকে শুরু করে নিরাপদে বাড়ি ফেরাতে সদা প্রস্তুত, সেখানে আমার প্রিয় বিদ্যালয়ের একজন ছাত্র বাবার সাথে কৃষি কাজে সহায়তা শেষে, একজন মেয়ে মায়ের কাজে সাহায্য শেষে, সঠিক সময়ে ক্লাসরুমে উপস্থিত থাকে। এমনকি নিরাপদে বাড়ি ফিরতে নিজেকেই সেই ঝুঁকি নিতে হয়। শহরের একটি বিদ্যালয়ের এসেম্বলি যেখানে সোনার বাংলা গাওয়া আর পিটির মধ্যে শেষ হয় সেখানে আমার বিদ্যালয়ের এসেম্বলিতে কোরআন তেলাওয়াত দিয়ে শুরু হয়ে গীতা পাঠ, ত্রিপিটক পাঠ এবং বাইবেল পাঠ হয়। এরপর সোনার বাংলা গাওয়া শেষে মুখরিত পরিবেশে সুনাগরিক হওয়ার শপথ পাঠ আর পিটি করানো হয়। এরপর শিক্ষার্থীরা সারিবদ্ধভাবে নিজ নিজ ক্লাসরুমে নীরবে ক্লাসে মগ্ন হয়ে যায়। এমনকি কয়েকবছর ধরে উপজেলার মুষ্টিমেয় ৪/৫ জন বোর্ডবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের নামের পাশে আমার নগন্য বিদ্যালয়টিও স্থান পেয়ে আসছে। যার মাঝে আমি হিমেলও একজন। এটাই আমাদের বিদ্যালয়।

হিমেলের কথা শেষ হতে না হতেই আংকেলসহ সবাই হাততালি দেওয়া শুরু করল। ভদ্রলোক এবার বলললেন, “হিমেল তোমার কথা শুনে মন চাইছে শৈশবে আবার ফিরে গিয়ে তোমার উচ্চ বিদ্যালয়ে একবার পড়ে আসি। কী অপরুপা গ্রামের বিদ্যালয় এবং কত সুশৃঙ্খল বিদ্যালয়ের নিয়মনীতি।“

বলতে বলতে কোন সময় যেন চবি স্টেশনে পৌঁছে গেল শাটল কেউ টের পায়নি। এরপর সবাই ট্রেন থেকে নেমে, সবাইকে আংকেল বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন। তারাও সবাই ক্লাসে চলে গেলো। আর এভাবেই স্মৃতিতে চবির শাটল সংলাপের যবনিকাপাত হল।