বেলা প্রায় বারোটা বাজে। শফিক ফোনের রিংটোনের শব্দে নড়েচড়ে উঠে চোখ বন্ধ অবস্থায় আধোঘুমেই কল রিসিভ করলো।

-হ্যালো?

-এখনো ঘুমাচ্ছো তুমি?

অপরপ্রান্তের কন্ঠ কানে আসতেই শফিক পুরোপুরি জেগে গেল। রাইতার কণ্ঠ।

বেশি বেলা পর্যন্ত ঘুমাতে রাইতা বারণ করেছিলো। সারারাত না ঘুমালে দিনে না ঘুমিয়ে কখন ঘুমাবে, তাই শফিক বুঝে না। কিন্তু সে অযথা তর্কও করে না। বললো,

-না, শুয়ে শুয়ে পড়ছিলাম তো তাই একটু ঘুম ঘুম লাগছে।

-শুয়ে পড়ছিলে কেন? শুয়ে পড়তে নিষেধ করেছিলাম না?

-হুম, আর পড়বো না।

-আচ্ছা আমাদের যে আজ দেখা করার কথা, মনে আছে তো?

-হ্যাঁ, মনে আছে। কখন বেরোচ্ছো?

শফিকের আদতে মনে ছিলো না। কিন্তু তা এখন বললে ফলাফল ভালো হবে না।

-এই বিকেলে বের হবো;আমার ঘড়িটা ভেঙ্গে গেছে। নতুন একটা কেনা লাগবে আজ।

-আচ্ছা কিনো। এখন তাহলে রাখি?

– আচ্ছা।

ফোন রেখে শফিক বিছানার পাশে থাকা চেয়ারে ঝোলানো কালো থেকে ধূসর এবং খয়েরির মাঝামাঝি কোনো এক নামহীন রং এ পরিণত হওয়া প্যান্টের পকেট থেকে ওয়ালেটটা নিলো হাত বাড়িয়ে। মাসের শেষ সপ্তাহ। ওয়ালেটের ভেতরের এবং বাহিরের অবস্থার মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। মাত্র পাঁচশো টাকা আছে সব মিলিয়ে। শফিক ভেবেছিলো রাইতা এলে পাঁচশো টাকায় রেঁস্তোরা খরচ এবং রাইতার বাসায় ফিরে যাওয়ার রিক্সা ভাড়া হয়ে যাবে। কিন্তু এখন যুক্ত হলো ঘড়ি। মাসের শুরুতে টিউশনের বেতন পেলে কিছু উপহার দেয় রাইতাকে শফিক এবং প্রত্যেক মাসের শেষেই রাইতার কিছু না কিছু ভেঙে যায়, নষ্ট হয়ে যায় নাহয় হারিয়ে যায়।

শফিক তার রুমমেট মারুফের বিছানার দিকে একবার তাকিয়ে সাথে সাথে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো। মারুফের নিম্নাঙ্গের সকল ধরনের পোশাক বর্তমানে উধ্বাঙ্গে অবস্থান করছে। মারুফকে অনেক বলেও এই স্বভাব পরিবর্তন করানো যায়নি। এমনকি লুঙ্গীর পরিবর্তে প্যান্ট পরে ঘুমালেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না। মারুফের ব্যাখা হলো, তার নাকে-কানে শীত বেশি লাগে তাই রাত বাড়লে সে নিম্নাঙ্গের বস্ত্র দিয়ে উধ্বাঙ্গের শীত নিবারণ করে এবং কখন কিভাবে সে নিজ হস্তে এই কাজ সম্পাদন করে তা তার মনে থাকে না। এখানে বলে রাখা ভালো, তাকে উধ্বাঙ্গের শীত নিবারণের জন্য প্রচুর কাঁথা- কম্বল সরবরাহ করেও কোনো লাভ হয় নি। শফিকের অনেক দিনের ইচ্ছে, কোনো একদিন মারুফ ঘুমানোর পরে তার দু’ হাত বেঁধে দিবে। কিন্তু বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হওয়ার পরেও মারুফ এক বছরের বড় হওয়ায় শফিক এখনো একাজ করার সাহস করে উঠতে পারেনি।

শফিক আবার ফোন হাতে নিয়ে মারুফের নম্বরে ডায়াল করলো। বিকট এক হিন্দি গান উচ্চস্বরে বেজে উঠলো। মারুফ ডান চোখ অর্ধেক খুলে ফোনের স্ক্রীনে তাকিয়ে, বিরক্তি মেশানো কণ্ঠে অর্থহীন শব্দ করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,

-এক রূমের মধ্যে থাইকা কল দেও কেন?

– আপনার যে অবস্থা ভাই, এমনি ডেকে তো জাগানোর উপায় নাই।

-কি অবস্থা,হুহ? তোমার নাই নাকি এসব?  আইছে যে অবস্থা কইতে।

মারুফ সারা মুখের চামড়া কুঁচকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মাথায় জড়ানো লুঙ্গীখানা যথাস্থানে পরলো। শফিকের মতে, এমনভাবে সারা মুখের চামড়া কুঁচকানোর প্রতিভা বাংলাদেশে শুধু মারুফের আছে। হয়তো পুরো বিশ্বেই শুধু মারুফেরই আছে। সুযোগের অভাবে মারুফের প্রতিভা বিকশিত হচ্ছে না।

রূমের সাথে লাগানো, বরাবর একজন মানুষের মাপে বানানো টয়লেট থেকে কাজ সেরে এসে মারুফ ফোন হাতে নিতে নিতে বললো,

  • কও এবার, এত সকাল সকাল কী মহৎ কাজের জন্য জাগাইলা আমারে? কোথায় ত্রাণ বিতরণ করবা?

ইতিহাসের কোনো এক কোনে সোনালী অক্ষরে  লেখা রয়েছে, মারুফ একবার বর্ন্যার্ত অঞ্চলে ত্রাণ বিতরণের জন্য গিয়েছিলো কোনো এক সংগঠনের সাথে। এবং মারুফের সাথে নতুন কারো দেখা হলেই নিজের পরিচয়ের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের বর্ণনা দিতে এখনো ভুল করে না সে।

-ভাই, আমারে এক হাজার টাকা ধার দিতে পারবেন? বেতন পেলে দিয়ে দিবো।

-মাসের শেষ সপ্তাহে তুমি এক হাজার টাকা কোন আক্কেলে চাও মিয়া?

-ভাই চেষ্টা করেননা একটু দরকার ছিলো

-আগে দরকারটা কি সেটা কও আমারে। তারপর ভাইবা দেখতেছি।

-ভাই আসলে,রাইতা আসবে আজকে দেখা করতে।

-রাইতা ? মানে তোমার ওই ভূতড়ে গার্লফ্রেন্ড?  আচ্ছা তোমার ওই রাইতাটা কি আসলে আছে? আমরা কেউ আজ পর্যন্ত দেখলাম না। এই মেস এর সবাই সবার গার্লফ্রেন্ডেরে  চিনে, দেখা করেছে, আড্ডা দেয়। অনেকে তো আবার একজন আরেকজনের সাথে পরিবর্তনও করে নিয়েছে। তোমার রাইতারে কেউ দেখলাম না আমরা, কি প্রেম করো মিয়া তুমি? নাকি ভং ধরো? ছবি পর্যন্ত দেখলাম না কোনোদিন।

-ভাই, টাকাটা ম্যানেজ করে দিতে পারবেন?

মারুফ কিছুক্ষন ভেবে বললো,

-আচ্ছা ম্যানেজ করলাম আরকি। আমিসহ যামু। আজ তোমাদের দুজনেরে আমি ট্রীট দিমু। ঠিক আছে?

শফিক বুঝতে পারছে মারুফ রাইতাকে দেখার জন্যই এই প্রস্তাব দিয়েছে। একবার ভাবলো মানা করে দিবে। পরে কি মনে করে রাজি হয়ে গেল।

আছরের আজানের পরে মারুফ খুব সেজেগুজে, এক গাদা পারফিউম মেখে

শফিককে নিয়ে রাইতার সাথে দেখা করতে চললো।

শফিক -মারুফ রেঁস্তোরায় বসে রাইতার জন্য অপেক্ষা করছে। মারুফ বসে বসে ফোন ঘাটাচ্ছে। হঠাৎ শফিক এর হাতের গুতোয় চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো সামনে আপাদমস্তক বোরখায় ডাকা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শফিক বললো,

-মারুফ ভাই, এই হলো রাইতা।রাইতা, উনি আমার বড় ভাই।

রাইতা ছোট করে সালাম দিলো মারুফকে।

মারুফের সারা মুখের চামড়া কুঁচকে গেছে। ভীষন বিরক্ত লাগছে মারুফের। এই দেখার জন্য এতগুলা টাকা গচ্ছা দিতে এসেছে সে? প্রেম করতে এসে আবার হুজুরনি সেজেছে। যত্তসব।  মারুফ মুখ গম্ভীর করে ওয়েটারকে ডেকে সবজি পরোটা দিতে বললো। শফিকের দিকে তাকিয়ে বললো,

-আমার তো বিকালে নাস্তা করা হয় নাই। তোমরা অন্য কিছু খেলে অর্ডার দাও।

শফিক তাড়াতাড়ি হেসে বললো,

-না ভাই, আমরাও এই খাবো।

মারুফ এবার বেশ কর্কশ কণ্ঠেই রাইতাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে শুরু করলো, ভাইবোন কতজন, বাবা কি করে এসব। হঠাৎ মারুফ শফিকের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

-নাচতে নেমে ঘোমটা দেয়া উচিৎ না, বুজলা শফিক। নাচতে নামলে ঘোমটা তো খুলতে হয়েই আঁচলও খুলে ফেলা ভালো।

শফিকের দু’কান লাল হয়ে উঠলো। রাইতা মাথা নীঁচু করে বসে রইল। একটু পরে খাবার এলে রাইতা হাত বের করলো কালো বোরখার আড়াল থেকে।

রাইতার হাতের দিকে নজর পড়তেই মারুফের মনে হলো কেউ তাকে এক হাজার ভোল্ট এর শক দিয়েছে। এত সুন্দর হাত মানুষেরও হয়! প্রতিটা আঙুল এত সুন্দর! মারুফ কালো মুখোশে ডাকা রাইতার মুখের দিকে তাকালো। খাওয়ার সময়েও মেয়েটা মুখোশ খুলে নি। মুখোশের ভেতর হাত ঢুকিয়ে কিভাবে যেন খাচ্ছে। মারুফের ইচ্ছে হলো একটা থাপ্পড় দিয়ে রাইতার মুখোশ খোলাতে।

খাওয়া শেষে রাইতা বললো সে আজ ঘড়ি কিনবে না আর। শফিক রাইতাকে রিক্সায় উঠিয়ে দিয়ে মারুফকে নিয়ে মেস এ ফিরে এল। মারুফ তখন থেকে আর একটা কথাও বলে নি। তার চোখের সামনে ওই হাতটা ভাসছে শুধু। মারুফ বিছানায় বইয়ের সামনে বসে থাকা শফিকের দিকে তাকাল। এই ছেলে সারারাত জেগে পড়ে। কি এত পড়ে?

-আচ্ছা শফিক, তুমি রাইতাকে দেখো নাই?

-দেখেছি তো ভাই।

-ও কি সবসময়ে এমন বোরখা পরে ?

-জ্বি ভাই।

-বোরখা ছাড়া ওর একটা ছবিও তোমারে দেয় না?

-দেয় তো ভাই মাঝে মাঝে।  কেন?

-না এমনি।

-ও আচ্ছা।

মারুফ এবার উঠে গিয়ে পাশের রুমের হৃদয়কে কি যেন বললো। এই মেস এর সবচেয়ে মাস্তান ছেলে হৃদয়। হৃদয় বেশ কয়েকবার খ্যাঁ খ্যাঁ করে হেসে উঠলো। তারপর মারুফের সাথে উঠে এলো। শফিক গভীর মনোযোগে বইয়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এসব সে লক্ষ্য করেনি। হঠাৎ মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলো হৃদয় আর মারুফ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মারুফ বললো,

-দেখো শফিক, তোমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা হইল, পরিচয় হইল কিন্তু তার চেহারা দেখলাম না। এটা কেমন দেখায়। সে তো আমাদের ভাবীই হইব সম্পর্কে। ভাবীরে দেখতে দোষ কি? ঠিক কিনা হৃদয়?

শফিক বুঝতে পারলো এই দুইজনের উদ্দেশ্য। সে একটু হেসে বললো,

-সে তো আপনি বাস্তবেই দেখছেন।

-বাস্তবে তো মুখ দেখি নাই।

-ভাই ওর মুখ দেখায় না ও।

-হ্যাঁ ঠিক আছে তো, আমরা তো আর তারে বলতেছি না দেখাইতে। তুমি দেখাও আমাদের। আমরা আমরাই তো।

-কিন্তু ও তো আমাকে নিষেধ করছে কাউকে দেখাইতে।

– আচ্ছা ঠিক আছে তুমি তারে বলিও না যে আমাদের দেখাইছ। তাহলেই তো হলো।

-না ভাই আমি এটা করতে পারবো না। সে আমারে বিশ্বাস করে দিয়েছে ছবি।  আমি তার বিশ্বাস ভাঙতে পারবো না।

-আরেহ মিয়া আমরা তো একবারই দেখুম। কিছু হইব না। তুমি দেখাও।

-না ভাই আমি এটা করবো না।

হৃদয় ছেলেটা অধৈর্য প্রকৃতির। সে এতক্ষণ বহুকষ্টে চুপ করে ছিলো। আর পারলো না। খেঁকিয়ে উঠলো কুকুরের মতো,

-ওই, এত তর্ক করস কেন? ছবিই তো দেখতে চাইছি। রেপ তো আর করতেছি না। এত সমস্যা কেন?

শফিকের মাথায় আগুন ধরে গেল। ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলো হৃদয়ের গালে। হৃদয় প্রথমে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল শফিকের দিকে। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল শফিকের উপর। শফিকের দুই হাত বন্দি করে ফেললো নিমিষেই। মারুফকে বললো,

-ভাই ওর ফোনটা নিয়ে ওর আঙুলের ছাপ দিয়ে লক খোলেন। জলদি।

মারুফ হৃদয়ের কথামত লক খুললো। শফিক প্রথমে ক্রুব্ধ হয়ে তারপর মিনতি করে বারবার বারণ করতে লাগলো মারুফকে। হৃদয় তাকে ঠেলতে ঠেলতে টয়লেটে ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা আটকে দিলো। শফিক বেশ কয়েকবার জোরে জোরে দরজায় থাবা দিয়ে খুলতে অনুরোধ করলো। যখন বুঝতে পারলো খুলবে না তখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।

হ্যাঁ, ওইতো শোনা গেছে ভয় এবং ঘৃনা মেশানো চিৎকার। এসিডে ঝলসানো রাইতার মুখ দেখে শুধু শফিকই এই ভয়- ঘৃনা মেশানো চিৎকারটা দেয় নি। যে দেখে সেইই ভয় পায় ওই নাক চোখ ঠোঁট হীন মুখটা দেখে। কেন পায় বুঝে না শফিক। তার তো একটুও ভয় লাগে না। একটুও ঘৃণা লাগে না। তার তো একটুও মনে হয় না যে, মুখটাতে নাক, চোখ, ঠোঁটের অস্তিত্ব নেই। সে অনেকবার ওই গাল ছুঁয়ে দেখেছে। ওই চোখ ছুঁয়েছে। ওই ঠোঁট থেকে চুমু নিয়েছে।

ঝ্বনাত শব্দে টয়লেটের দরজা খুলে গেলো। হৃদয় ওকে এক টানে বের করে দিয়ে ওয়াক ওয়াক করে বমি করছে। মারুফ রুমের মেঝে ভাসিয়ে ফেলেছে ইতোমধ্যে।  শফিক মেঝেতে পড়ে থাকা নিজের ফোনটা হাতে নিলো। ফোনের স্ক্রীনে দেখা যাচ্ছে রাইতাকে। কই একটুও তো খারাপ লাগছে না শফিকের। একটুকরো স্নেহের হাসি ফুটে উঠলো বরং তার ঠোঁটে। তার এখন ইচ্ছে করছে আবার রাইতার গালটা একটু করে ছুঁয়ে দিতে। আপনমনেই ফোনের স্ক্রীনে রাইতার মুখে ঠোঁটে আঙুল রাখলো শফিক।