নিউ নরমাল বলতে আমরা কি বুঝি?
“নিউ নরমাল” কথাটি ইদানিং খুব ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন আলোচনায়, অনলাইনে, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায়।
কোন আর্থ – সামাজিক সংকটের পর সবকিছু যখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আস্তে আস্তে স্থিতিশীল হয়ে আসে সেটাই “নিউ নরমাল” । কিন্তু নূতন সময়ে অনেক কিছুই আগের মত থাকেনা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিই আমাদের সামনে নূতন বাস্তবতা হিসেবে এসে দাঁড়ায়।
২০০৭ সালের আর্থিক সংকটের পর সারা পৃথিবীতে ২০০৮ – ২০১২ এর রেসেশানের ফলে যে আর্থিক দৈন্যের সূচনা হয় এবং কোভিড – ১৯ এর ফলে যে আর্থ–সামাজিক সংকট ও জনস্বাস্থ্যের হুমকি তৈরি হয়েছে তাকেই “নিউ নরমাল” বলা হচ্ছে।
কোভিড-১৯ এর কোন টিকা এখনও আবিষ্কার হয়নি। এর টিকা আবিষ্কার নাও হতে পারে। অনেক ভাইরাসজনিত রোগের টিকা আজও আবিষ্কার হয়নি। এছাড়াও কোভিড-১৯ এর মিউটেশানের হার বেশি। সেক্ষত্রে কার্যকর টিকা আবিষ্কারের সম্ভাবনা আরও কমে যায়। তবুও আমরা আশাবাদী থাকতে চাই। সাথে সাথে বাস্তববাদী হওয়াটাও আমাদের অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজন।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে, কর্মস্থলে, পারিবারিক আবহে- সব জায়গায় আমাদের জীবনযাপন পদ্ধতি ও অন্যদের সাথে মেলামেশার রীতিনীতি এখন পাল্টে ফেলতে হচ্ছে। নিজেকে ঝুঁকিমুক্ত রাখা ও অন্যের ঝুঁকির কারণ না হওয়া – এখন আমাদের জীবনের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত।
এই ভাইরাসের অস্তিত্ত্ব মেনে নিয়ে আমাদের সবকিছু এমন ভাবে গুছাতে হবে যাতে আমাদের মাঝে সংক্রমণের হার কমে যায়। এছাড়াও আমাদের পড়াশুনা, কাজ ভার্চুয়ালি বা অনলাইনে করতে বলা হচ্ছে।
আমরা হইহুল্লোড় প্রিয়, আমরা আড্ডা দিতে ভালবাসি। সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে আমরা বেশ ঘটা করে, আনন্দ নিয়ে যোগ দেই। সাম্প্রতিক কালে আমাদের ভ্রমণ প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক।
এমন একটা অবস্থায়, আমাদের বলা হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে। লোকসমাগম থেকে দূরে থাকতে। একদম প্রয়োজন ছাড়া বের না হতে। আমাদের প্রবৃত্তি অনুযায়ী এটা মেনে নেওয়া কঠিন। তাই আমরা সবাই এক যাদুকরের অপেক্ষায় আছি, যিনি ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে আমাদের এই দমবন্ধ পরিবেশ থেকে মুক্তি দেবেন।
কিন্তু যদি তা না হয়? তাহলে আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার চেষ্টা করতে হবে। অথবা হার্ড ইমিউনিটিতে না পৌঁছা পর্যন্ত আমরা আক্রান্ত হতেই থাকবো।
তত্ত্বগত ভাবে “নিউ নরমাল” বেশ শ্রুতিমধুর ও আকর্ষনীয়।কিন্তু পৃথিবীর কয়টি দেশ ও কত শতাংশ লোকের পক্ষে এই স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা সম্ভব! কত শতাংশ লোকের ইন্টারনেট ব্যবহারের সামর্থ্য আছে? ভার্চুয়াল বা অনলাইনে পড়াশুনা ও কাজ করার ভৌত অবকাঠামো কত শতাংশ লোকের আছে?
আমরা আগের যে অবস্থাকে “নরমাল” বলছি, তা কি পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের জন্য নরমাল ছিল? যদি আগের “নরমাল” সত্যিকার অর্থে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের জন্য কার্যকর না হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে “নিউ নরমালের” ধারণাও শুরুতেই হোঁচট খায়।
পৃথিবীতে ১০ কোটির বেশি লোক গৃহহীন। পকেট ভারী থাকলে কিংবা মাসিক বেতন নিশ্চিত থাকলে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব অনেকাংশে মেনে চলা সম্ভব। কিন্তু যারা দৈনিক মুজুরিতে কাজ করেন? তারা কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে জীবিকা অর্জন করবেন!
নাইজেরিয়াতে ৩০ মার্চ থেকে লকডাউন শুরু হবার পর বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা বিশ্বাস করেন “করোনা” ভাইরাসের চেয়ে “ক্ষুধা” ভাইরাসে তাদের মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি। এই বাস্তবতা পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
উন্নত বিশ্বে ৮৭ শতাংশ লোকের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ আছে, অন্যদিকে অনুন্নত দেশে মাত্র ১৯ শতাংশ লোকের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ আছে।
আমেরিকার শিকাগোতে করোনা ভাইরাসের প্রভাবে মারা যাওয়া লোকের সংখ্যা দক্ষিণ আমেরিকান ও আফ্রিকানদের মধ্যে অনেক বেশি। মারা যাওয়া লোকদের মধ্যে ৭০% আফ্রিকান আমেরিকান। অথচ তারা জনসংখ্যার মাত্র ৩০%। সেখানেও আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে প্রাণের মুল্য উঠানামা করে। হেলথ ইনসুরেন্স না থাকলে আমেরিকায় চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। অল্প আয়ে ইনসুরেন্স কাভারেজ পাওয়াও কঠিন।
গৃহহীন ও কর্মহীন, স্বাস্থ্যসেবার সুযোগবিহীন লোকেদের স্থান “নিউ নরমাল” এ কোথায়? ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান সহ এ ধরণের দেশগুলোর মানুষদের জন্য “নিউ নরমাল” তত্ত্ব কীভাবে প্রয়োগ হবে? যেখানে সামাজিক সুরক্ষা মানুষের তুলনায় অপ্রতুল। এক সাইজের পোশাক সবার জন্য কাজে লাগবে না।
আর্থিকভাবে অভিজাতদের জন্য প্রযোজ্য ধারণা বা তত্ত্ব, পৃথিবীর সব ধরণের মানুষের জন্য প্রয়োগ করা একেবারেই বাস্তবতা বিবর্জিত।
আরেক দিক দিয়ে বিবেচনা করলে এই তত্ত্ব আমাদের এমন এক ভ্রান্তির মধ্যে নিয়ে যেতে চায়, যাতে আমরা বর্তমান প্রযুক্তি বান্ধব পুজিঁবাদী ব্যবস্থার অসারত্ব ভুলে যাই। আমাদের প্রতিনিয়ত বলা হচ্ছে আমরা আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় বাস করছি। মাইক্রোসফট, এপেল, গুগল, স্পেস এক্স, নাইকি, ফোর্ড, ইত্যাদি মানুষের বিপদের সময়ে পাশে নেই। এত প্রযুক্তি, এত পুজিঁর সঞ্চালন, এত বড় বড় ধনী দেশ মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে পারছেনা। তাদের এই ব্যর্থতা ঢাকতে মানুষের মৌলিক শক্তি অভিযোজন ক্ষমতাকে নূতন বোতলে উপস্থাপন করছে। মানুষ তার নিজের ক্ষমতায় শত শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে টিকে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। মানুষের অন্তর্নিহিত ক্ষমতাকে “নিউ নরমাল” নাম দিয়ে মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। আমাদের বিশ্বাস করানো হচ্ছে নূতন এক তত্ত্ব আবিষ্কারের মাধ্যমে তারা আমাদের প্রতি দায়িত্বপালনে বিশাল সাফল্য দেখিয়েছে। অথচ এই সংকটের সময়ে সব শঠতা ভুলে সবাই এক সাথে লড়াই শুরু করা দরকার।
আর্থিক সামর্থ্য, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, ভৌগলিক অবস্থান, আবহওয়া, জনসংখ্যার ঘনত্ব সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু কার্যকর পদ্ধতি প্রয়োজন এই ভাইরাস মোকাবেলার জন্য।
কলোম্বিয়া আদমশুমারি, আর্থিক জরিপ, সামাজিক জরিপ, ও প্রশাসনিক তথ্যের সমন্বয়ে জরুরি আগ্রাধিকার ভিত্তিতে নাগরিকদের জন্য অর্থ সাহায্যের ব্যবস্থা করেছে। আমরাও এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারি।
স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের অন্তর্ভূক্তি, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদদের দিক নির্দেশনা এবং স্থানীয় লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহার আমাদের প্রাণহানী ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারে।
কোভিড-১৯ এ প্রবীণদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে পড়তে পারেন কোভিড -১৯ মহামারী ও প্রবীণদের মানসিক স্বাস্থ্য।
Pingback: কোভিড -১৯ মহামারী ও প্রবীণদের মানসিক স্বাস্থ্য | Songshoptok
উন্নত দেশের ইকো-সিস্টেম শক্তিশালী। সোশ্যাল সেফটি নেট অনেক শক্তিশালী, মানুষেরা শিক্ষিত ও সচেতন, সরকার দায়িত্বশীল। অন -উন্নত দেশে অনেক কিছুই করা যায়না। এই করোনা জীবিকা এবং ঘরে থাকার বড় চ্যালেঞ্জ তাদের জন্য।