২০০১ সালে আমি ক্যাম্পাস ছেড়ে চশমা পাহাড়ের একটা রুমে উঠি। সরকার পরিবর্তনের পর তৎকালীন ভিসি নূতন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন, যাতে উনি আরও কিছু দিন ভিসি থাকতে পারেন। তার এই চেষ্টার বলি হলাম আমরা হাজার হাজার শিক্ষার্থী। একটানা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল আট মাস।

এই বন্ধেরই কোন একদিনে, দুপুরে খেয়ে শুয়ে শুয়ে কল্পনায় রাজা উজির মারছি। এমন সময় আমার এক পরিচিত এলেন ধার শোধ করতে।

টাকা দিয়ে কি করব? ভাবছিলাম।

মনে হল কক্সবাজার যাব। আগে কখনো যাওয়া হয়নি।

কাউকে কিছু না বলে ছোট একটা ব্যাগে কয়েকটা প্রয়োজনীয় কাপড় আর টুথব্রাশ নিয়ে রওনা দিলাম।

হেঁটে যাবার সময় এক মুদি দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, “ চাচা, কক্সবাজার কীভাবে যাব?” চাচা উত্তর দিলেন, “বদ্দার হাট থেইক্কা যাওন যাইব।”

আমি রিকসা নিয়ে বদ্দার হাটে গিয়ে এক লোকাল বাস পেয়ে তাতে চড়ে বসলাম।

ভাবলাম, সময় আর কত বেশি লাগবে? এক বা দেড় ঘণ্টা! আস্তে আস্তে গেলে যাওয়ার পথের দু’ধারে ভাল করে দেখা যাবে।

বাস ছাড়ল এক ঘণ্টা পর। আস্তে আস্তে যাচ্ছে। লোক নামাচ্ছে, আর তুলছে। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম আমি ছাড়া বাসে কক্সবাজারের কোন যাত্রী নেই।

আরও কিছুক্ষণ যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম এটা বাড়ী বাড়ী এক্সপ্রেস! পারলে বাড়ী থেকে নিয়ে আসে যাত্রী। কিছুক্ষণ বিরক্ত হয়ে থাকি। কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থাকলে মন ভাল হয়ে যায়। কিন্তু সারাক্ষণ মনে হয়েছিল, আমি বাংলাদেশের বাইরে কোথাও আছি। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা তখন আমি একদম বুঝিনা।

অবশেষে ছয় ঘন্টা পর আমি কক্সবাজার বাসস্ট্যান্ডে এসে নামলাম। তখন রাত বাজে নয়টা। কাছেই একটা হোটেলে ব্যাগ রেখে বের হলাম সমুদ্র সৈকতে যাব।

এক রিক্সা ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, “বীচে যাবেন?”

সে যা উত্তর দিল তাতে বুঝতে পারলাম, এই সময়ে কেউ বীচে নেই। পরদিন সকালে গেলে ভাল। আমি যেতে চাইলে সে নিয়ে যাবে।

আমি তাও তাকে নিয়ে বীচের দিকে যাচ্ছি। কিছুদূর যাওয়ার পর বুঝলাম সাগরের বাতাস শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। ঢেউয়ের গুঞ্জন কানে আসছে। আমি উন্মূখ হয়ে পড়লাম, পানিতে পা ভেজাবার জন্য। আস্তে আস্তে ঢেউয়ের গুঞ্জন গর্জনে রূপ নিল। অবশেষে সাগরের ঢেউ আমার দৃষ্টিসীমায় চলে আসল।

রিক্সা ছেড়ে এইবার বালুর মধ্যে হাঁটতে লাগলাম। বাতাসের ঝাপটা লাগছে, বাতাস শো শো করে বয়ে যাচ্ছে। কোথাও কেউ নেই মনে হচ্ছে। চারিদিকে অন্ধকার।আকাশে শুধু চাঁদের আলো। কয়েকটা তারাও দেখা যাচ্ছে। সব দোকানপাট বন্ধ। এমন সময় দেখি বিচের দিক থেকে দু’টো গাড়ীর হেড লাইটের আলো সমুদ্রের দিকে মুখ করে জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। হেড লাইটের তীব্র আলোয় সফেদ ঢেউ নেচে নেচে তীরে আছড়ে পড়ছে। আলোর বাইরের সমুদ্রে শুধু ঢেউয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

আমি সমুদ্রের গর্জনে বোধহীন ও নেশাগ্রস্থ হয়ে গাড়ী দু’টোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আরেকটু কাছে যেতেই বুঝলাম গাড়ীগুলোতে করে আত্মীয়রা একসাথে এসেছেন।

গাড়ীর আরেকটু কাছে যেতে সংশয় কাজ করছে। আরেকটু এগিয়ে যেতেই, মনে হল চেনা একটা সুর ভেসে আসছে কানে। চারিদিকে তাকিয়ে উৎস খুঁজছি। শেষে বুঝলাম, গাড়ী থেকেই গানের সুর ভেসে আসছে।

একটু একটু করে এগিয়ে গেলাম। গান বেজেই চলছে। “মাই হার্ট উইল গো অন … .” একটা পারিবারিক মিলন মেলার কাছাকাছি থাকা উচিত না। সেটা বুঝতে পারছি।

কিন্তু গান, ঢেউয়ের আলোড়ন, বাতাস সব কিছু মিলে একটা অপার্থিব বোধের জন্ম নিয়েছে। যা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। আমার পা দু’টোও যেন সে ইন্দ্রজালে বালুর মাঝে আটকে গেছে। গানটাও রিপিট মুডে দেওয়া আছে। সব ইন্দ্রিয় দিয়ে সুর আর সুন্দরে ভেসে যাচ্ছি।  

কতক্ষণ এমন ছিলাম, জানিনা। আমার সময়ের বোধ লোপ পেয়ে গিয়েছিল।

এক সময় গান থেমে গেল। সবাই গাড়ীতে উঠে চলে গেল। আমি ভূতগ্রস্থের মত দাঁড়িয়ে রইলাম সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আরও কিছুক্ষণ। কিছুটা অগোছালো হয়ে, কল্পলোকের অনুভূতির স্মৃতি নিয়ে আস্তে আস্তে ফিরে গেলাম এক রাতের ডেরায়।