শরীফ মিয়া ত্রিশতম কই মাছটি টুকরিতে ফেলে ডোবা থেকে উঠে আসলেন। বর্ষার মৌসুমে প্রচুর ডিমওয়ালা পেটফোলা কই-পুঁটি মাছ পাওয়া যায় ডোবা-পুকুরে। শরীফ মিয়া কেরানি বাড়ির দিকে চললেন। পুরো গ্রামের মধ্যে এই বাড়ির অবস্থা তূলনামুলক ভালো। বুড়ো কেরানি মারা গেছেন বেশ কয়েকবছর হলো। এখন কেরানি বাড়ির বাসিন্দা, বুড়োর বুড়ি আর তার একমাত্র ছেলে রমিজ। অবশ্য রমিজ গেল বছর থেকে শহরে কাজ পেয়েছে বলে তাকে খুব একটা বাড়িতে দেখা যায় না। শরীফ মিয়ার একমাত্র মেয়ে তরীর সাথে রমিজের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে অনেকদিন। আজ রমিজ বাড়িতে আসার কথা। এবারেই শুভ কাজটা সম্পুর্ণ করার ইচ্ছে সবার। তরী অবশ্য শরীফ মিয়ার একেবারে নিজের মেয়ে নয় কিন্তু সেটা সবাই জানে।
‘বুবু, ও বুবু? ঘরে আছোনি?’ কেরানি বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়েই চলছেন শরীফ মিয়া। দরজাটা একটুখানি খুলে বুড়ি উঠোনে শরীফ মিয়াকে দেখে পুরোপুরি খুলে উঠোনে নেমে দাঁড়ালেন।
‘ওমা! আমার বেয়াই দেখি, হঠাৎ বুড়িরে দেখতে আইছেন? বলি মাইয়্যাটারে এবার তাড়াতাড়ি আমার কাছে পাঠান। কেমন একা একা থাকন লাগে….’
শরীফ মিয়া জানেন বুড়ির একটু বেশি কথা বলার স্বভাব আছে। তাড়াতাড়ি বুড়িকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ বুবু, একটা কিছু দাওতো। এক্কেবারে দামড়ি দামড়ি কই পাইছি। রমিজ তো আইজকা আইতাছে, কেমন?’
বুড়ি একবার একবার শরীফ মিয়ার টুকরির দিকে তাকালেন, তারপর ঘরে পাতিল আনতে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, ‘হ, কইছে তো আইবো।‘ বুড়ি মনে মনে খুব খুশি হয়েছেন। বেয়াই মানুষের দেওয়ার স্বভাব থাকা ভালো। তাছাড়া এসব মাছ রমিজের অনেক পছন্দের। কিন্তু লোকবলের অভাবে বুড়ি জোগাড় করতে পারেননা। একটা পাতিলে পানি ভরে নিয়ে শরীফ মিয়ার সামনে এনে রাখলেন। ইচ্ছে করে একটু বড় পাতিলই এনেছেন। শরীফ মিয়া গুনে গুনে বিশটি মাছ পাতিলে রাখলেন। বুড়ি যদিও খুশি হয়েছেন তবু বললেন, ‘আরে মিয়া, সব তো দেখি দিয়া দিতাছো। তোমরা তিনজন। তোমাগোই না বেশি লাগতো। ‘
শরীফ মিয়া একটু হেসে বললেন,’ এই তো আমরা সারাবছরই খাই। রমিজেরে রাঁইন্ধা দিও।‘
বুড়িও এবার হেসে বললেন,’ আমি বুড়া মানুষ, কি আর রাঁনমু? তোমার মাইয়ারে বাড়িত যাই পাঠাই দিও। আমাগো লগে খাইবো দুপুরে। রমিজ দুপুরের আগেই আইয়া পড়বো।‘
শরীফ মিয়া রাজি হলেন। বললেন, ‘ আইচ্ছা আমি তরীরে পাঠাই দিমুনে।‘
তরীর প্রতিদিন সকালের খাবার খেতেই এগারোটা বেজে যায়। তার একজন ভোজনসঙ্গী আছে। কিন্তু আজ ভোজনসঙ্গীটি এখোনো না আসায় সাড়ে এগারোটা বেজে গেলেও তরী খাবার নিয়ে বসেনি। সঙ্গীটি একটি মিশকালো স্বাস্থবতী কুকুর।
আরো একবার মুখ সুঁচালো করে তরী কুকুরটিকে ডেকে প্লেট হাতে নদীর পাড়ের খেজুর গাছটার গোড়ায় গিয়ে বসলো। তরীদের ঘরের একদম সামনেই এই খেজুর গাছটা আর তারপরই নদী। আগে আরো দূরে ছিলো নদী। আরো কয়েকটা খেজুর গাছ ছিলো। সেগুলো নদীর ক্ষুধা মেটাতে আত্মাহুতি দিয়েছে। এখন এই একটিই আছে। তরী গাছের গোড়ায় গিয়ে বসতেই তার ভোজনসঙ্গী কুকুরটি ঘরের পেছন থেকে ছুটে বেরোল। কিন্তু নদীর কাছে এলো না। ঘরের সামনে থেকেই চেঁচাতে লাগলো। বার বার ডাকার পরও না আসাতে রাগ করে তরী একাই খাওয়া শুরু করে দিলো। তবু কুকুরটি এলো না নদীর কাছে। প্লেটের একপাশে অর্ধেক খাবার আলাদা করে রাখলো তরী। বাকি অর্ধেক নিজে খেয়ে কিছু মুরগীকে দিয়ে শেষ করে উঠে আসলো কুকুরটার কাছে। প্লেট থেকে মাত্র খাবার নিচে ঢেলে দিচ্ছিলো কুকুরটাকে , এই সময় শরীফ মিয়ার বউ আর তরী যাকে মা হিসেবে জানে, ‘রাণী’ ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। একবার ভ্রু কুঁচকে তরীর দিকে তাকালেন। তারপর কুকুরটার দিকে তাকালেন।
‘ বলি খাবার যত আছে সব এই কুত্তারে আর ওই মোরগ হাঁসেরে দিয়ে নিজের পেটে কি কিছু গেছে নাকি? দু’দিন পরে শ্বশুরবাড়িতে যাইব। তখন শ্বাশুড়ি কইব মায়ে ভাত দে নয়। এজন্যি স্বাস্থের এই অবস্থা। কুত্তাটা কেমন মোটা তাজা হইতাছে দিন দিন। ওইডারে দেইখাও নিজের স্বাস্থের দিকে চোখ পড়ে না। পোড়াকাঠ একটা হইছে।‘
‘আহ, মা! তোমার নজর লাইগবো কুত্তাটার। থুথু দাও তাড়াতাড়ি। ‘ হেসে বলে তরী ঘরে চলে গেল। রাণী কিছুক্ষণ তরীর গমনপথে চেয়ে রইলেন। তারপর রান্নাঘর থেকে ভাতের হাঁড়ি নিয়ে নদীর ধারে চলে গেলেন ধুতে। আজ নদীর পানি কেমন যেন একটু বেশী উতলা। রাণীর মনে পড়লো যেদিন তরীর আসল মা বাবা ভেসে গিয়েছিলেন। তরীর তখন বয়স ছয় মাস পার হয়েছিল হয়তো। নদীর ওপারে ছিল তরীদের ঘর। তরীদের ঘরের পেছনেই রাণীদের ঘর ছিল। নিঃসন্তান রাণী প্রায়ই তরীকে কোলে করে নিজের কাছে নিয়ে আসতেন। সেদিনও নিয়ে এসেছিলেন তরীকে। তরী ঘুমিয়ে যাওয়ায় সন্ধার অনেক পরেও তাকে দিয়ে আসা হয় নি সেদিন। আর সন্ধায়ই তো নদীর যেন সহস্র বছরের ঘুম ভেঙেছিল। আর তার সহস্র বছরের ক্ষুধা মিটিয়েছিলো হিংস্রতার সর্বোচ্চ পরিমান দিয়ে। সে বার রাণীদের ঘর সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলো। কিন্তু শরীফ মিয়া আর ওই জায়াগায় থাকার সাহস করেননি। ছ’মাস বয়সী তরীকে নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন নদী। এপারে এসে ঘর বেঁধেছিলেন। তরীর বাবা মা হিসেবে নতুন জীবন শুরু করেছিলেন। গ্রামের সবাই অবশ্য জানে যে তরী শরীফ মিয়ার আপন মেয়ে নয়। এপার আর ওপার অত দূরে তো আর নয়। সব খবরই আসে যায়। তরীও নিজের ছোটবেলার গল্প জানে। কিন্তু সে তার বাবা মা হিসেবে শরীফ মিয়া এবং রাণীকেই চিনে। ওসব তার কাছে কেবল গল্পই মনে হয়। সত্যিকারে তার জীবনে ঘটেছে বলে মনে হয় না। নদীর পানিতে হালকাভাবে পা ডোবালেন রাণী। নাহ, আজ স্রোত একটু বেশীই মনে হচ্ছে। এখান থেকেও যত দ্রুত সম্ভব পালাতে হবে। তরীর বিয়েটা হয়ে গেলেই হাত পা ঝাড়া।
পাতিল ধুয়ে উঠে এসে রাণী দেখলেন শরীফ মিয়া রান্নাঘরে ছোট বালতিতে মাছ রাখছে। রাণীকে দেখে বললেন, ‘বুবু কইছে তোমার মাইয়ারের পাঠাইতা। রমিজ আইতাছে। দুপুরে সেখানে খাইব।‘
রাণী অসন্তুষ্ট গলায় বললেন, ‘ দুই দিন বাদে তো একেবারের জন্যই যাইব। এখন এত যাইবার কি আছে?’
‘ আহহা, বিকালে তো আবার চলি আইব। পাঠাই দাও।‘ শরীফ মিয়া নদীর দিকে যেতে যেতে বললেন।
রাণী আর কিছু না বলে ঘরে ঢুকে দেখলেন তরী দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। রাণীকে দেখেই বললো, ‘ আমি যামু না, মা’
‘কেন?’
‘আমার শরম লাগে’ মুখ নিঁচু করে জবাব দিল তরী। সারা গাল তার লজ্জার প্রমাণ দিচ্ছে।
রাণী তরীর অবস্থা দেখে হেসে ফেললেন। মেয়েটা তার আসলেই অনেক রূপবতী হয়েছে। মেয়েদের রূপ হয় প্রচন্ড সুখ এনে দেয়, নাহয় প্রচন্ড দুঃখ এনে দেয়। তার মেয়েটা যেন প্রচন্ড সুখী হয়, ভাবলেন রাণী। তারপর তরীর হাত ধরে নিজের ঘরে নিয়ে একটা গাঢ়ো সবুজ রঙ এর শাড়ী পরিয়ে দিলেন। এত সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন রাণী। শরিফ মিয়াও হাত পা ধুয়ে ঘরে এসে থমকে গেলেন। একটা সবুজ নবীন পাতা যেন তার ঘরে হাঁটছে। তারপর হেসে বললেন, ‘ মাশাল্লাহ, আমার তরীরে আমি দিয়া আসতেছি তাইলে।‘
‘এখন আবার যাইবা তুমি ওই বাড়িত?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন রাণী।
‘ হ, গেলে কি হইব? বাদলার দিন। সাপের উপর পা দিবো মাইয়া ভুলে। আমি দিয়া আসতেছি। চল মা।‘
রাণী চুপ করে রইলেন। তার নিজেরও কেন যেন তরীর সাথে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু চক্ষুলজ্জার কারণে তা আর বললেননা।
কিছুক্ষণ পরে তরী আর শরিফ মিয়া বের হয়ে গেলেন। রাণী রান্নাঘরে ঢুকলেন। একটু পরে স্রোতের শোঁ শোঁ শব্দে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালেন। নাহ নদীর অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না। চিন্তিত মুখে আবার রান্নাঘরে এসে ঢুকলেন।
ভাতের হাঁড়িটা সবে চুলা থেকে নামিয়েছেন রাণী, হঠাৎ পায়ের নিচের মাটি যেন কেঁপে উঠলো। বাইরে শব্দও প্রচুর বেড়েছে। হাঁড়ি নিচে রেখে দৌড়ে বাইরে এলেন রাণী। তারপর অবশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলেন খেজুর গাছটা নেই। তার পায়ের পাতার চেয়ে সর্বোচ্চ এক হাত দূরে নদী যেন প্রচন্ড ক্ষুধায় ফুঁসছে। রাণী হঠাৎ বুঝতে পারলেননা তিনি কি ঘরে যাবেন নাকি রাস্তার দিকে দৌড়াবেন। একটুখানি দ্বিধা, ব্যস নদী তার শিকারকে আর ছাড়লো না। রাণীর মনে হলো তাকে কেউ। ইট ভাঙার মেশিনে ফেলে দিয়েছে। পানিও যে এত শক্ত হয় কখোনো ভাবতে পারেনি রাণী। নদীতে হাবুডুবু খেতে খেতে রাণী দেখলো তাদের ঘর যেন ডিমের খোসার মতো ভেঙে যাচ্ছে। রাণী বুঝতে পারলেন এখান থেকে না সরে গেলে ঘর ভাঙা টুকরো গুলো তার গায়ে এসে পড়বে। কিন্তু স্রোতের বিরুদ্ধে তিনি এক চুলও নড়তে পারলেননা। ঘরের ছুটন্ত দরজাটা এসে দড়াম করে রাণীর পেটে আঘাত করলো। রানীর আর কিছুই করার ক্ষমতা থাকলো না। ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছেন তিনি। হাত পা নাড়ানোর শক্তিও নেই।
শরিফ মিয়া রাস্তা ধরে আসছিলেন। প্রথমে দেখলেন ভাতের পাতিলটা পানিতে ভাসছে। দৌড়ে আরো কিছুদুর আসার পরে ঘরের টিনের এক খন্ড দেখতে পেলেন ডুবে যাচ্ছে। শরিফ মিয়ার হাটু ভেঙে আসতে লাগলো। এই দৃশ্য তিনি আরো একবার দেখেছিলেন। তরীর বাবা মা যেদিন ভেসে গিয়েছিলেন। হঠাৎ চোখে পড়লো একটু শাড়ির অংশ ভেসে আছে পানিতে। রাণীর শাড়ির অংশ। আর কিছু ভাবতে পারলেননা। প্রচন্ড স্রোতের মধ্যে নেমে পড়লেন অন্ধের মতো। শাড়ির অংশটি তার লক্ষ্য। অনেক কষ্টে শাড়ির অংশটির কাছে পৌঁছালেন। কিন্তু না, ওটা শুধু শাড়িই। মানূষ নেই। আর পারলেননা। হু হু করে কেঁদে উঠলেন শরিফ মিয়া।
নদী তার দুর্বল শিকারকে কোনোভাবেই যেতে দিবে না। প্রচন্ড স্রোতের ধাক্কা শরিফ মিয়ার গায়ে এসে লাগলো। ভাসিয়ে নিয়ে গেল তাকে বহুদূর। শরিফ মিয়া আর কিনারা দেখতে পেলেন না। এখান থেকে যে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব না তা শরিফ মিয়া বুঝতে পারলেন। তার চোখের সামনে তরীর চেহারা ভেসে উঠলো। নাহ রমিজ ছেলেটা ভালোই। নিশ্চয় তরীকে আপন করে নিবে।
বিকেলে সব শান্ত হয়ে গেল। নদী আবার ঘুমিয়ে পড়লো। শুধু খেজুর গাছটা আর শরিফ মিয়ার ঘরটা দেখা গেল না। পৃথিবীর বিশলাতার কাছে অতি ক্ষুদ্র পরিবর্তন। তরীকে দিয়ে যেতে রমিজ তরীর সাথে আসছিল। তরীর লজ্জা কেটে গেছে। সে বক বক করে চলছে। হঠাৎ,রমিজ তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘ তোর খেজুর গাছটা কইরে?’
তরী প্রথমে বুজলো না খেজুর গাছ কই মানে কি? তারপর সামনে তাকিয়ে প্রথমে অবিশ্বাস তারপর ভয় ফুটে উঠলো তরীর চোখে। দৌড়ে আরো কিছুদুর এসে থমকে গেল। নাহ নেই। কোনো ঘরের চিহ্নমাত্র নেই। যেন কখোনো ছিলই না। রমিজও তরীর পেছন পেছন এলো। আশে পাশে খুজতে লাগলো কোনো মানুষ অথবা কোনো লাশ। তরী নদীর দিকে চেয়ে রইল। নদী যেন তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। নিষ্ঠুর হাসি। রমিজ যখন বুজলো কিছু পাওয়া যাবে না, তখন তরীর কাছে সরে এলো। তরীর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার মনে পড়লো, ছোটবেলায় তরীকে নিয়ে সবাই বলাবলি করতো। তরীকে রাক্ষুসী বলতো। তখন সে এসবের মানে বুজতে পারেনি। বড় হওয়ার পর তরীর রূপ তাকে সব কিছু ভুলিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এখন তার মনে হলো কিভাবে দু’ দু’ বারই তরী বেঁচে গেল! নিজের অজান্তেই রমিজ কিছুটা সরে দাঁড়ালো।
তরীর এসবে খেয়াল নেই। সে নদীর দিকে চেয়েই আছে। নদী যেন তার চোখের জলও কেড়ে নিয়েছে। সে নদীর আঘাতে নিঃস্ব তরী।