সাক্ষাৎকারের পূর্বে

১৫-১৬ বছরের শিক্ষা জীবন শেষে আমরা ভীষণ আতঙ্ক নিয়ে পত্রিকা খুলে হন্য হয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখতে থাকি। আমাদের জীবনের তখন একটা জিনিসকে আলাদীনের চেরাগ বলে মনে হয়। সেটা হল, “চাকুরি”।

আমাদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের একমাত্র উপায় নিজের সার্টিফিকেটের জোরে নিয়োগ প্রক্রিয়ার ডাক পাওয়া। আর কলম ও ধৈর্য্যের জোরে একটা চাকুরি পেয়ে, এই দেশে নিজের মান- সন্মান বাঁচানো। পড়াশুনা শেষ করার পর হাজার হাজার মানুষের দূর্বিষহ প্রশ্ন, “কি কর?” থেকে বাঁচতে একটাই উপায়। একটা চাকুরি পাওয়া।

যে সময়টাতে ছেলে-মেয়েদের মানসিক শক্তি যোগানোর মানুষ চারিপাশে সবচেয়ে বেশি দরকার, সে সময়ে আমাদের চারপাশটা একেবারে খালি হয়ে যায়। আমারা নিঃসঙ্গ, হতাশা আর আত্মবিশ্বাসের দোলাচালে দুলতে দুলতে চাকুরির জন্য আবেদন করতে থাকি। যা পাই তাতেই আবেদন করি।

তার পর শুরু সেই প্রতীক্ষা, কবে আসবে ই-মেইল/মেসেজ/কল/চিঠি। এই সময়ের উৎকণ্ঠা আমার লেখায় তুলে আনা সম্ভব নয়।

এই রকম জটিল মানসিক অবস্থায় আমরা যখন সাক্ষাৎকার দিতে যাই, মানসিক চাপে আমরা বিভিন্ন হাস্যকর কাজ করি, প্রশ্নের অদ্ভূত উত্তর দেই!

ঘটনা – ১

আইবিএস নামে একটা রোগ আছে। এতে মানসিক চাপে পড়লে মনে হয় টয়লেট চেপেছে। সে অনুভুতি খুব তীব্র। তখন পৃথিবীর অন্য কিছু বাদ দিয়ে টয়লেট খোঁজাটাই একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়ায়।

একছেলে মাস্টার্স দিয়ে ঢাকা একটা মেসে এসে উঠেছে চাকুরির জন্য পড়াশুনা করবে আর চাকুরির পরীক্ষা দিবে। বন্ধুরা একসাথে উঠেছে। পড়ার চেয়ে আড্ডাই বেশি হয়। সবাই মিলে খুব বড় একটা সরকারী ব্যাংকে আবেদন করল। দিনের পর দিন গড়িয়ে যায়। প্রতিদিন কুরিয়ারে খোঁজ নেয় লিখিত পরীক্ষার চিঠি আসল কিনা! এক সময়ে সে চিঠি আসে। সে পরীক্ষাও দেয়। অপেক্ষার পালা শেষে সাক্ষাৎকারের চিঠিও আসে।

সে এই চাকুরিটা খুব চায়। এতে তার উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়। সাক্ষাৎকারে ডাক পাওয়া প্রার্থীদের নামের তালিকায় তার নাম একেবারে উপরের দিকে। সে গিয়ে বসল। একজন এসে জানালেন ১-৩ যারা আছেন, তারা এসেছেন কিনা? তার উৎকণ্ঠা আরও বেড়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ডাক আসবে। সে পারবেত!

হঠাৎ তার মনে হল, তল পেটে খুব ব্যাথা করছে। তাকে টয়লেটে যেতেই হবে। এদিকে যে কোন সময়ে তার ডাক আসবে! থাকার চেষ্টা করে বুজল হবেনা। তাই এবার টয়লেট খুঁজতে শুরু করল। খুঁজে খুঁজে টয়লেট পেল। তার প্রাকৃতিক কর্ম শেষ করল। হাত-মুখ ধুয়ে ভাবল, এতক্ষণে অন্যদের সাক্ষাৎকারে ডাকা হয়ে গেছে। এবারে তার সুযোগ শেষ। পরের সাক্ষাৎকারে দুঃশ্চিন্তা করা যাবেনা। এই ভেবে আস্তে ধীরে হেলে দুলে হাঁটছে।

হঠাৎ মনে হল, কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে। সে শব্দের উৎসের দিকে তাকিয়ে দেখে এক লোক তার নাম ধরে ডাকছে, আর হাঁপাতে হাঁপাতে তার কাছে এসে বলল, “আপনি …?”

সে বলল, “জ্বি!”

  • আপনি এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? খাতায় আপনার সই আছে কিন্তু আপনে নাই! তাড়াতাড়ি আসেন। স্যাররা সবাই আপনার জন্য গত ১৫ মিনিট ধরে বসে আছে। এই কথা শুনে তার অবস্থা আরও খারাপ। ইর্ন্টারভিউ বোর্ডে কোথায় ছিল? এ কথার উত্তরে কি বলবে!
  • আরে আসেন! আসেন! এত চিন্তা বাদ দিয়া তাড়াতাড়ি আসেন।

অবশেষে সে ইর্ন্টারভিউ বোর্ডের সামনে এসে দাঁড়ালো।

রুমে একটু উঁকি দিয়ে বলল, “আসতে পারি?”

  • আপনি জনাব …?
  • জ্বি স্যার।
  • আসুন, বসুন।

সে দুরু দুরু বক্ষ্যে তার জন্য নির্ধারিত সীটে গিয়ে বসল।

  • আপনি এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? আমরা এতজন লোক আপনার জন্য অপেক্ষা করছি ১৫-২০ মিনিট। কি হয়েছে?
  • স্যার সত্যি কথা বলব?
  • অবশ্যই সত্যিটাই বলবেন!
  • স্যার, টয়লেটে গিয়েছিলাম।
  • বাসা থেকে ফ্রেস হয়ে আসেনি?
  • এসেছি।
  • তা হলে?
  • আমার বেশি টেনশান হলে, টয়লেটে যেতে হয়।
  • বলেন কি! আপনি কীভাবে ব্যাংকে চাকুরি করবেন? কাউন্টারে বেশি টাকা দেখলেত আপনি টাকা রেখে টেনশানে টয়লেটে চলে যাবেন!
  • স্যার এই প্রথম ইর্ন্টারভিউ, তাই বেশি টেনশান হয়েছে, আর হবেনা!
  • আচ্ছা এবার তাহলে আপনাকে প্রশ্ন করা শুরু করি। সব চিন্তা বাদ দিয়ে উত্তর দিন।

পাঠকের কাছে প্রশ্ন রইল তিনি নির্বাচিত হয়েছেন কিনা?

ঘটনা – ২

লিখিত পরীক্ষা দিয়ে সাক্ষাৎকারের ডাক পেয়েছি। সকাল দশটায় ইর্ন্টারভিউ। রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম থাকতে পারে, এই ভেবে তাড়াতাড়ি রওনা দিয়ে সকাল ৯ টা ১৫ মিনিটে পৌঁছে গেলাম।  সাইন করার জন্য কয়েকটা শীট দিয়ে গেল। সবাই সাইন করল। ১০ টা বাজার পর একজন এসে বলে গেলেন কিছুক্ষণের মধ্যে ইন্টারভিউ শুরু হবে। তিনি আবার ১১টায় আসলেন। এরপর প্রতি ঘন্টায় একবার করে এসে জানান দিয়ে যান, “কিছুক্ষণের মধ্যেই ইন্টারভিউ শুরু হবে।“ ঘড়িতে ১টা বাজার পর তিনি আবার আসলেন। আমরা তার কাছে খাবার খেতে নিচে যেতে অনুমতি চাইলাম। তিনি খুব গম্ভীর কন্ঠে বললেন, “তাড়াতাড়ি চলে আসবেন, স্যাররা যে কোন সময়ে এসে পড়বেন।“

আমি নিচে গিয়ে বার্গারের মত কিছু একটা খেয়ে তাড়াহুড়া করে ফিরে আসলাম। একটা খালি সোফায় বসলাম। এবার আস্তে আস্তে ঢুলতে শুরু করলাম। আমি ঝিমাচ্ছি। নকিব ঠিক ২টায় এসে আবার বল্লেন,”কিছুক্ষণের মধ্যেই ইন্টারভিউ শুরু হবে।” তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। ভার্সিটির ক্লাসরুম, শেওয়াপাড়ার বাসা, মধুপুরের রাস্তা অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে একে একে আমি যাচ্ছিলাম।

মনে হল ভোর বেলায় কে যেন আমাকে ডাকছে। আমি খুব বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে দেখি  একজন আমার মুখের কাছে এসে ডাকছে। চারদিকে তাকিয়ে দেখি আমি মধুপুরে নেই। একটা কর্পোরেট অফিসে সোফায় ঘাড় এলিয়ে আছি। এবার মনে হল সবকিছু। আমি সাক্ষাৎকার দিতে এসেছি। অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছি। আমার সাথের একজন আমাকে ডাকছেন। আমি হুড়মুড় করে উঠে বাথরুম খুঁজে বের করলাম। চোখে মুখে পানি দিয়ে বসলাম। তবুও ঝিমাচ্ছি। সবকিছু কেমন যেন ঘোলাটে লাগছে। বুঝলাম অবশেষে ইন্টারভিউ শুরু হয়েছে। চারজন পর আমার ডাক আসবে। একে একে সবাই বেরিয়ে আসল। শুধু একজনের মুখে হাসি দেখলাম। জানা গেল তার বাড়ী আর প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের বাড়ী একই এলাকায়।

আমার পালা আসল। আমি ইন্টারভিঊ বোর্ডে ঢুকে সালাম দিলাম। একজন আমাকে বসতে বললেন। আমি বসলাম। এবার অন্য একজন আমার সিভি দেখে প্রশ্ন করলেন, “ইংরেজি পড়েছেন?”

  • জ্বি।
  • এমেরিকান লিটারেচার পড়েছেন?

আমার মাথা কাজ করছে না। ভাবলাম, তিনি যখন বলেছেন তাইলে আমি পড়েছি।

  • জ্বি পড়েছি।
  • আমেরিকার দশটা স্টেটের নাম বলতে পারবেন?

আমি তখন একদম শুন্য হয়ে গেছি। ভাবছি আমেরিকা কোথায়? স্টেট কি? আমার শুন্য দৃষ্টি দেখে প্রশ্ন কর্তা অবাক হয়ে,” কয়েকটার নাম অন্তত বলুন?”

আর এদিকে আমি ভেবেই চলেছি আমেরিকা কোথায়? স্টেট কি?

  • মে ফ্লাওয়ার শীপ কোথায় অবতরণ করেছিল?

আমি ভাবছি এই প্রশ্নের উত্তর কি হবে?

প্রশ্নকর্তা খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি তাকে বললাম, “এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার জানা নেই।”

তিনি খুব অবাক ও রাগান্বিত হয়ে বললেন, “ আপনি আসতে পারেন!”

ইন্টারভিউ খারাপ হয়েছে, সেটা আমার মাথায় কাজ করছিল না।  আমি বেরিয়ে এসে কারো সাথে কোন কথা না বলে ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম,” আমেরিকা দেশটা আসলে কোথায়?” এটা কি আমি জানি? তাহলে মনে পড়েনি কেন? এই প্রশ্নের উত্তর কার কাছে পাওয়া যাবে?

পাঠকের কাছে এবারও প্রশ্ন রইল, চাকুরি প্রার্থীর চাকুরিটা হয়েছিল কিনা?

একটি ভিন্নধর্মী সাক্ষাৎকার সম্পর্কে জানতে পড়ুন ” মজার সাক্ষাৎকার “