রুহ বা আত্মা কি? জড় ও জীবের মাঝে কি এমন অদৃশ্য বস্তু আছে যার উপস্হিতির ফলে জড়বস্ত প্রাণী হয়ে উঠে। প্রাণের উৎপত্তির রহস্য প্রত্যেক চিন্তাশীল মানুষের মননে নিত্য জাগ্রত এক জিজ্ঞাসা। কেনইবা এ পৃথিবীতে এলাম আর কেনইবা এত সুন্দর অস্তিত্বের শুন্যে বিলীন হওয়া। বেঁচে থাকার সময় মৃত্যুকে অনেক দুরের মনে হওয়া, আবার সন্তর্পণে প্রস্হানের পর একসময়ের এত দৃপ্ত বিচরণের ও এত সুন্দর চেতনার এতটুকু চিহ্ন না থাকার ব্যাপারটা বোধের জগতে কি যে কষ্টের ঢেউ তোলে!
যার ফলে প্রত্যেক কৌতূহুলী মন সবসময় খুঁজে ফিরেছে জীবনের উৎপত্তির কারন পেতে। কবে, কোথায় ও কিভাবে জীবনের সূচনা হলো? পৃথিবীটাইবা কোত্থেকে এল? জীবনের অর্থই বা কি? জীবন বা প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে মানুষের এই জিজ্ঞাসার আলোচনা হচ্ছে জেনেসিস বা জীবনের উৎপত্তি । পাশাপাশি দর্শনশাস্ত্রের বিভিন্ন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে জীবনের অর্থ।
জীবনের উৎপত্তি বা জেনেসিসের আলোচনা বৈজ্ঞানিক পরিমন্ডলে মূলত: দুই ধারায় বিভক্ত। জৈবজনন বিশ্বাস করে সকল জীবনের/প্রাণের জন্ম কেবল আরেকটি প্রাণ থেকেই উদ্ভুত। অপরদিকে অজৈবজনন এর ধারনা হচ্ছে জীবনের উৎপত্তি হচ্ছে বস্তু বা জড় পদার্থ থেকে।সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞানের মনযোগ অজৈবজনন প্রক্রিয়া ধাপগুলোর দিকেই বিশেষভাবে নিবদ্ধ। তাই এখানে স্বল্প পরিসরে জেনেসিসের আলোচনা মূলত অজৈবজনন প্রক্রিয়ার দু-একটি বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

সংশয় ও বিশ্বাসের প্যারামিটার বা পরিমানের উপর ভিত্তি করে প্রাণের উৎপত্তির বিভিন্ন ব্যাখ্যাসমূহকে পর্যানুক্রমিকভাবে মোটামুটি চারভাবে শ্রেণীবিন্যাস করা যেতে পারে:
১. ব্যাখ্যাতীত দৈব ঘটনা/ অজ্ঞেয়বাদী ভাবনা
২. বৈজ্ঞানিক কারণ/বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
৩. দার্শনিক ঈশ্বর
৪. অলৌকিক কারন/ধর্মীয় ব্যাখ্যা

১. ব্যাখ্যাতীত দৈব ঘটনা:

প্রাণের অস্তিত্বের যথার্থ ও স্বপ্রমানিত ব্যাখ্যা পাওয়া মানুষের সাধ্যাতীত ব্যাপার। যদিও প্রাণের অস্ত্বিত্বের ঘটনাপ্রবাহ অনেক ক্ষেত্রে পদার্থ ও রসায়নবিদ্যার তত্ত্ব ও ফর্মুলার সাথে পুরোপুরি আনুক্রমিকভাবে সঙ্গতিপূর্ণ কিন্ত স্ট্যাটিসকলী কিংবা সম্ভাব্যতার সূত্রে এটা এতটাই দৈব ও আকস্মিক ঘটনা যার সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর পাওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রাণের উৎপত্তি ঘটানোর জন্য কিছু অনু পরমানুর দৈব অবস্হান যা এই মহাবিশ্বের বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালাক্সির মধ্যে, আবার এক এক গ্যালাক্সির মধ্যে বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্রের মধ্যে, আবার প্রত্যেক নক্ষত্রের বিলিয়ন গ্রহ ও উপগ্রহের মধ্যে শুধু এই একটি কিংবা সামান্য কয়েকটি জায়গায়—কারন পৃথিবীর মতো প্রাণের অস্ত্বিত্ব আর কোথাও প্রায় নেই বললেই চলে—তা ঘটা পরিসংখ্যানগত দিক দিয়ে একটি অসম্ভব ব্যাপার । আর প্রাণের উৎপত্তি যদি এটাই বা এভাবেই হয়ে থাকে, তা ব্যাখ্যা করা বিজ্ঞানের আওতার বাইরেই বলা চলে। সহজ কথায়, প্রাণের উৎপত্তি অসীম এ মহাবিশ্বের মধ্যে শুধু এ পৃথিবীর মতো এত ক্ষুদ্র জায়গায় ঘটার সূত্র আবিষ্কার করা মানুষের সাধ্যাতীত। এখানেই এভাবে কেন প্রাণের অস্তিত্ব ঘটবে আর অন্য কোথাও নয় কেন?—এ ব্যাখ্যা কারো জানা নেই। দার্শনিকভাবে নিশ্চিতভাবে না জানার এ ব্যর্থতাকে মেনে নেয়ার নাম অজ্ঞেয়বাদ বা । ‘আই সিম্পলি ডুন নো’ হচ্ছে এ জাতীয় বিজ্ঞানীদের আপ্ত বানী। তাদের মতে, যে বিষয়ের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই বা যাকে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষনের আলোয় দেখা সম্ভব নয়, তাকে বিশ্বাস করার কোনো যুক্তি নেই। মানুষ এ সকল অদৃশ্য বিষয় নিয়ে সন্তোষজনক বুদ্ধিগম্য ব্যাখ্যা পেতে সক্ষম নয়। সাধারনত: অজ্ঞেয়বাদের ধারনা ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতার বিষয়ে সম্যক জ্ঞান না থাকার বিষযের সাথে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু অধিবিদ্যা সংক্রান্ত বিষয়ে চুড়ান্ত ও পরম না কিছু খুঁজে পাওয়ার এই অবস্হানকে অজ্ঞেয়বাদের সমার্থক হিসেবে কল্পনা করা যায়। সংশয়বাদ বা অবিশ্বাসের মাপকাঠিতে এটা হচ্ছে সংশয়বাদের সর্বোচ্চ ও আদর্শ অবস্হান।

২. বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা কসমিক ইমপারেটিভ:

উপযুক্ত চাপ ও তাপে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের সন্নিবেশের ফলে যেমন পানির উৎপত্তি হয়,তেমনি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যানুযায়ী প্রানের উৎপত্তিও একটি অমোঘ, অনিবার্য নিয়তি হিসেবে ধরা হয়। প্রাণের অস্তিত্ত্ব একটি অবশ্যাম্ভাবী ঘটনা যদি আমরা উপযুক্ত পরিবেশ, পর্যাপ্ত সময়, অত্যাবশ্যকীয় উপাদানের সন্নিবেশ, দরকারী শক্তির যোগান —এ সকল বিষয়ের যুগপৎ সমাবেশের মহাজাগতিক ঘটনাচক্র মেনে নিই।
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যানুযায়ী প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে এমন কিছু অত্যাবশ্যকীয় ধাপে, যে ধাপগুলোর প্রত্যেকটিকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। বিজ্ঞান বিশ্বাস করে জীবন প্রথমত: সহজ সরল রাসায়নিক বিক্রিয়া ভিন্ন অন্য কিছু নয়।পরবর্তীতে এই সরল-সাধারণ রাসায়নিক বিক্রিয়া ক্রমে ক্রমে জটিল থেকে জটিলতর জৈব-রাসায়নিক বিক্রিয়ায় রুপান্তরের মাধ্যমে প্রাণের সূচনা ঘটে।এটা একটা বৈজ্ঞানিক হাইপোথিসিস । এই হাইপোথিসিসের অনুসিদ্ধান্ত/ স্বীকার্য এই যে, বিজ্ঞান প্রাণের উৎপত্তি ও ক্রমবিবর্তনের প্রতিটি ধাপকে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণের ও পর্যবেক্ষণের লিটমাস টেস্ট দিয়ে যাচাই করার চ্যালেঞ্জ গ্রহন করে। বিজ্ঞান মানেই হচ্ছে পদ্ধতিগত লব্দ জ্ঞান যাকে যেকোনো সময় প্রমান করা যায়। তাই প্রাণের উৎপত্তির গবেষনার বেশ কিছু ধাপ প্রমানের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা প্রানের উৎপত্তির একটা সময়রেখা নির্ধারণ করেছেন যা দ্বারা প্রমান করতে চান উপযুক্ত নিয়ামকসমূহের ফলে প্রানের উৎপত্তি একটি অমোঘ, অনিবার্য ঘটনা।
ডারউইনের ঘোষনা ছিল মানুষ ও বানরের একটি সাধারন পূর্বপুরুষ ছিল, যার মোদ্দা কথা প্রায় এরকমই—মানুষ বানর বা বানরসদৃশ এরকম কোন প্রাণী থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে রুপান্তরিত প্রাণী। এ ঘটনা ১৮৫৯ সালের।
জৈব বিবর্তনের ধারনা বৈজ্ঞানিক পরিমন্ডলে ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে বিজ্ঞানীরা সূত্র খুঁজতে লাগলেন যেহেতু মানুষ ও উন্নত শ্রেনীর মানুষ ধারাবাহিকভাবে এককোষী প্রাণীর রুপান্তরিত রুপ, তাহলে প্রাণের অস্তিত্বও নিশ্চয়ই জড়বস্তু থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে উদ্ভুত একটি ক্রমধারাবাহিক প্রক্রিয়া। আর এ অজৈবজননের ঘটনাবলী বা ট্রেন্ডলাইনও এক চমৎকার বিষয়। উল্লেখ্য, ইতিমধ্যে ১৮২৮ সালে রসায়নবিদ ফ্রেডেরিখ উহলার সম্পূর্ণ অজৈব বস্তু অ্যামোনিয়াম সায়ানাইট থেকে জৈব বস্তু ইউরিয়া প্রস্তুত করতে সমর্থ হন। যার ফলে বিজ্ঞানীরা ভাবতে লাগলেন প্রানের উৎপত্তিও নিশ্চয় এরকমভাবে নির্জীব পদার্থ থেকে যেকোনো উপায়ে সংঘঠিত হয়েছিল।
শুরুতে জীববিজ্ঞানীরা ভাবলেন প্রাণের অস্তিত্ব কোষের মধ্যেই নিহিত কারণ একটি এককোষী প্রানীও বিপাক ক্রিয়ার মাধ্যমে জীবনের আবশ্যকীয় ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করে আর কোষেরই একমাত্র ক্ষমতা আছে আরেকটি কোষের জন্ম দেবার বা সেল্ফ রেপ্লিকেশনের পদ্ধতিতে বংশগতির ধারা অব্যাহত রাখার। এক কথায় কোষ হচ্ছে প্রাণের একক।
এবার বিজ্ঞানীরা কোষের দিকে মনযোগ নিবদ্ধ করে দেখলেন কোষের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে নিউক্লিয়াস তাহলে প্রাণ নিশ্চয় এখানে কোথাও থাকবে। এরপর নিউক্লিয়াসের আরো গভীরে প্রবেশের পর দেখা গেল নিওক্লিওলাস হচ্ছে নিউক্লিয়াসের প্রাণকেন্দ্র। এই নিওক্লিওলাসের মূল উপাদান হচ্ছে আরএনএ বা ডিএনএ । এই ডিএনএ বা আরএনএ এর একমাত্র সেল্ফ-রেপ্লিকেশনের ক্ষমতা আছে এ এখানের প্রোটিনের রয়েছে শক্তি উৎপন্ন করার বিপাকীয় ক্ষমতা। আবার এই ডিএনএ বা আরএনএ এক প্রকারের নিউক্লিক এসিড যা নির্জীব পদার্থ ভিন্ন অন্য কিছু নয়। যদিও কোষের মধ্যে প্রাপ্ত এই নিউক্লিক এসিড অন্য কোনো প্রানী থেকে উদ্ভুত বা জৈবজননে সৃষ্ট নিউক্লিক এসিড। তাই বিজ্ঞানীরা এবার চেষ্টা করতে লাগলেন এই জৈব অ্যামাইনো এসিড কোনোভাবে অজৈব যৌগ থেকে কৃত্রিমভাবে ল্যাবরেটরীতে বানানো যায় কি না।
১৯৫২ সালে মিলার-উরে পরীক্ষা করে দেখালেন সম্পূর্ণ অজৈব যৌগ থেকে অ্যামাইনো এসিড প্রস্তুত করা সম্ভব। তাদের এ আবিষ্কার অজৈবজননের গবেষনার ইতিহাসের যুগান্তকারী ঘটনা। তারা এ পরীক্ষার জন্য প্রি-বায়োটিক পৃথিবীর আদি অবস্হার পারিপার্শিকতার শর্তগুলো যোগান দিতে সচেষ্ট ছিলেন। কারন অজৈবজননের বৈজ্ঞানিক হাইপোথিসস ধরে নেয় জীবনের সূত্রপাত হয় একটি আদি তরল থেকে যা বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ বা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাণের সূচনা ঘটায়।
অনেক বিজ্ঞানী আবার এটাও মনে করেন জীবনের উৎপত্তি অন্য কোন গ্রহে যেখান থেকে উল্কা বা এ জাতীয় কোনো গ্রহানুর উপর ভর করে প্রাণ এ পৃথিবীতে আসে। যাহোক, প্রাণের উৎপত্তির রহস্যের কয়েকটি ধাপের ক্রিয়া-বিক্রিয়া উদঘাটন করা গেলেও এখন পূর্নাঙ্গ প্রক্রিয়া বা সর্বজনগ্রাহ্য রহস্যম্মোচন আজও সম্ভব হয়নি এবং বিজ্ঞানীরা এর রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে সবচেয়ে কৌতুহূলদ্দীপক বিষয় এই যে বিজ্ঞানীর আজও প্রাণের আদর্শ সংজ্ঞা দিতে পারেন নি যার ফলে এটাও ধোঁয়াশা থেকে যায় প্রাণ বলতে আসলেই কি বুঝায় যা আমরা খুঁজছি।বিষয়টা অন্ধকার ঘরে কালো বিড়াল খোঁজার মতো কিংবা গভীর জনসমুদ্রে মি. এক্স -কে খোঁজা যাকে তল্লাসকারী কখনও দেখেনি।
বিশ্বাসের মাপকাঠিতে এটা সংশয়বাদের সামান্য উপরে অবস্হিত।

৩. অতিপ্রাকৃত সত্তা / বুদ্ধিমান নকশাকারক:

জীবনের বিবর্তন ও এর রুপরেখা এতটাই জটিল যে এটা কোনো সাধারণ দৈব ঘটনা হতে পারে না বরং এর পেছনে নিশ্চয় একজন ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনার রয়েছেন যদিও তার স্বরূপ আমাদের কাছে পুরোপুরি অজানা। এর স্বপক্ষে এরকম যুক্তি দেয়া হয় যে, ধরুন আপনি একাকী জঙ্গল দিয়ে পথ চলতে চলতে একটি হাতঘড়ি কুড়িয়ে পেলেন। তৎক্ষনাৎ স্বাভাবিকভাবেই আপনার মনে হবে যদিও ঘড়ির নির্মাতাকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না কিন্তু এটা সহজে অনুমেয় এর একজন নির্মাতা ছিল। সেভাবে একটা ঘড়ির চেয়ে হাজার গুন বেশী জটিল একটা এককোষী প্রাণী কখনো কোন মহান নকশাকারক ছাড়া আবির্ভূত হতে পারে না, জটিল গঠনের কোনো প্রানীর উৎপত্তির কথা বাদই দিলাম।
এভাবে একজন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব অনুমান করার পেছনে আরো অনেক যুক্তি দেয়া হয়। যেমন, প্রথম কারণ হচ্ছে এমন একটি সত্তা যার অস্তিত্বশীলতার আর কোনো কারণ নেই । যদি তিনি কিভাবে এলেন প্রশ্ন করা হয় তাহলে আমরা চিরজীবনই একই প্রশ্ন করতে থাকব যাকে বলা হয় এটারনাল রিসেস।
সংশয়বাদীরা আবার এ দার্শনিক গডকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেন যে এ দার্শনিক ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রকারান্তরে মানুষের কল্পনার প্রতিফলন এবং বরং মানুষই এই ঈশ্বরের সৃষ্টিকর্তা।
যাহোক, বিশ্বাসের মানদন্ডে এটা বিশ্বাসের অনেকটুকু জায়গায় আলোকপাত করে কারন আমরা যেই লিপ অব ফেইথ এর কথা বলি তার প্রতিফলন এ শাখায় ঘটে। এ শাখায় ব্যক্তি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মন, আত্মা, ঈশ্বর ইত্যাদি বিষয়কে দার্শনিক আলোয় ফেলে দেখতে চান এটা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য। দর্শনের অনেকগুলো শাখা আছে যেমন, অধিবিদ্যা, জ্ঞানবিদ্যা, মূল্যবিদ্যা ইত্যাদি শাখা বিভিন্ন আঙ্গিকে বিবিধ বিষয়াবলি যেমন- জীবন কি, জীবনের উদ্দেশ্য বা অর্থ কি, নৈতিকতা কি, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলাপ করে। কিন্তু দার্শনিক এ অবস্হানের অসুবিধা হচ্ছে এটা জীবন পরিচালনার জন্য ধর্মীয় নির্দেশনাবলীর মতো সুনির্দিষ্ট পথ বাতলে দেয় না। যেহেতু দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রকারান্তরে মানুষই ঈশ্বর সৃ্ষ্টি করে, তাই এর দিক নির্দেশনাগুলোও ক্ষনে ক্ষনে দিক পাল্টায়। দার্শনিক ব্যাখ্যা নিত্য পরিবর্তনশীল কারন কোন দার্শনিকের ব্যাখ্যার বিরোধ নিয়ে পরবর্তী দার্শনিক তার ধারনা ও তত্ত্বের অবতারনা করেন।

৪. অলৌকিক কারণ/ ধর্মীয় ব্যাখা:

জীবনের সূচনা একটা অলৌকিক ব্যপার ।সৃষ্টিকর্তা এ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং এ মহাবিশ্বের সবকিছুই তার সৃষ্টি এবং তাঁর নির্দেশেই সবকিছু ঘটছে। বিগ ব্যাং হয়েছিল এবং এরপর ক্রমান্বয়ে প্রাণের সূচনা হয়েছিল বলে ধরে নেয়া হোক, তবুও এর পেছনের কারন অলৌকিক। ঈশ্বর নিয়মতান্ত্রিকভাবে ও সূত্রবদ্ধ নিয়মে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষকে বুদ্ধি ও মেধা দিয়েছেন এটা আবিষ্কার করার। পাশাপাশি স্রষ্টা এ জীবন পরিচালনার জন্য কিছু নিয়ম রেখেছেন ও ভালো-খারাপ নির্ধারন করেছেন।মানুষ তার নির্দেশিত পথে জীবন পরিচালনা করবে ও তাতে করে জীবনের অর্থ খুঁজে পাবে। এ অলৌকিক ব্যাপার সমূহ ও বিধি-বিধানসমূহ অলৌকিকতার সংজ্ঞানুযায়ীই বিজ্ঞান কর্তৃক ব্যাখ্যার উর্ধ্বে কিংবা দার্শনিক আঙ্গিকেও সবসময় বোধগম্য নয়। এ স্তর হচ্ছে বিশ্বাসের সর্বোচ্চ পর্যায়।
যেকোনো ধর্মই জীবন সৃষ্টির কারনসমূহ ও স্রষ্টা অভিপ্রায় পূঙ্খানুপূঙ্খরুপে বর্ণনা করে। বিশ্বাসী ব্যক্তি যেকোনোভাবে সেটা ধারণ করে ও সংশয়ের উর্ধ্বে উঠে তা মেনে নেয়। এখানে ঈশ্বরের আলোচনা একেশ্বরবাদকেন্দ্রিক । যারা প্রত্যাদেশ বা ওহীর বানীতে বিশ্বাস করেন তারা বিশ্বাস করেন ঈশ্বর তার প্রেরিত পুরুষ বা মেসেন্জারের মাধ্যমে তার অস্তিত্বের কথা মানুষকে ব্যক্ত করেছেন ও মানুষকে তাঁর নির্দেশিত পথে চলার নির্দেশ করেছেন। কেউ এই আদেশ লঙ্ঘন করলে পরজন্মে বা পরকালে শাস্তি পেতে হবে আর তাঁর নির্দেশিত পথে চললে পরকালে পুরষ্কারের ব্যবস্হা রয়েছে।
স্রষ্টার এ বানী প্রচারের জন্য স্রষ্টা কর্তৃক প্রেরিত পুরুষ ওহী বা আসমানী কিতাব প্রাপ্ত হয়েছেন। এ সকল বানী স্রষ্টা তাঁর নিজের স্বরূপ বিস্তারিত বর্ণনা না করলেও তার অস্তিত্বের কথা বয়ান করেছেন। জীবনের উৎপত্তির সহজ উত্তর হচ্ছে এটা স্রষ্টার আদেশ। রুহ বা আত্মা ঈশ্বরের আদেশেই সৃষ্টি আবার তাঁর আদেশেই এর প্রয়াণ ঘটে। জীবনের অর্থই হচ্ছে তাঁর নির্দেশিত পথ অনুসরণ করে পরকালে মুক্তি পাওয়া।
এই স্তর হচ্ছে বিশ্বাসের সর্বোচ্চ পর্যায় এবং সংশয়ের সর্বনিম্ন স্তর। একজন বিজ্ঞ লোক দুটো পথের সন্ধান দিলেন ও এটাও বর্ণনা করলেন কোন পথে যেতে হবে ও কেন যেতে হবে। এক পথে গেলে সহজে গন্তব্যে পৌঁছবে আর অন্য পথে গেলে পথ হারিয়ে বিপদে পড়তে হবে। এখন পথিকের যাচাই করার সুযোগ নেই কোনটা তার জন্য মঙ্গলজনক কেবল ওই লোককে বিশ্বাস করা ছাড়া। এখন দেখতে হবে সেই ব্যক্তি বা তার চারিত্রিক গুনাবলী কেমন? যিনি এই দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, তার কথায় আস্হা রাখা যায় কিনা? কিংবা যেই বার্তা বা ঔশী বাণী উনি দিয়েছেন সেটাও কতটা বিশ্বাসযোগ্য। যাহোক, এই বিশ্বাস বা সমর্পনের মাধ্যমে স্রষ্টার আলাদা সত্তা স্বীকার করে নেয়া হয় এবং নিজের ইচ্ছা ও চাওয়া-পাওয়াকে ঈশ্বরের চাওয়া-পাওয়ার কাছে গৌণ বা তুচ্ছ করে নেয়া হয়।
পরিশেষে, সংশয়, অবিশ্বাস কিংবা বিশ্বাস প্রায় পুরোটাই ব্যক্তির পছন্দ করা বা নির্বাচন করার বিষয় যেখানে বুদ্ধির চর্চা অনেক ক্ষেত্রে অসহায়। মানুষের নানবিধ সীমাবদ্ধতাই এই অসহায়ত্বের কারণ। যাহোক, উপরোক্ত প্রতিটা বিভাগেই কমবেশী বিশ্বাস অবিশ্বাসের উপাদান আছে। তবে শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসই হচ্ছে মুক্তি ও বিশ্বাসেই উত্তরণ। এমনকি বিজ্ঞান যা কিনা প্রমান নির্ভর জ্ঞান সেখানেও হাজারটা জায়গায় বিশ্বাসের উপাদানে ভরপুর। সেই আলোচনা হবে আরেকদিন।