অবশেষে মিসেস শামীম আরা রোজীকে লকারে ঢুকিয়ে তালা মেরে দিলেন।রোজী বিষণ্ণ চিত্তে আশেপাশে তাকায়।ভীষণ অন্ধকার চারদিকে।তিতলীর ভ্যানিটি ব্যাগেও এত অন্ধকার ছিল না।অথচ কত বিরক্ত লাগতো ভ্যানিটি ব্যাগে থাকতে।প্রাণটা হাসফাস করতো কখন তিতলীর ক্লাস শেষ হবে আর সে ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে বের হতে পারবে।রোজী জানে এই লকার থেকে আর কখনোই সে বের হতে পারবে না।সে নিচু স্বরে কাঁদতে শুরু করে।তিতলীর কথা খুব মনে পড়ে।তিতলীর হাজার হাজার ছবি এখনো সে বুকে ধারণ করে রেখেছে।তিতলীর কি কখনো মনে পড়বে রোজীর কথা?অথচ একসময় সে ছিল তিতলীর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। ২০১৭সালের সেপ্টেম্বর মাসে রোজী তার ভাইবোনদের সাথে বাংলাদেশে এসেছিল।তার গায়ের রং রোজ গোল্ড ছিল বলে মেয়েদের কাছে সে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে।রোজীর এখনো মনে পড়ে এমআই এওয়ান মডেলের ভাইবোনদের মধ্যে তার অন্যরকম কদর ছিল।বাজারে তার চাহিদা ছিল সর্বোচ্চ।আহা সেই দিন গুলি কোথায় হারিয়ে গেল। রোজীর কানে হঠাৎ ফিসফাস আওয়াজ ভেসে আসলো।কারা যেন কথা বলছে।

রোজী ভীত কন্ঠে বলল,”কে?কে ওখানে?”

-আমি গোল্ডি।তোমার সাথে অনেকদিন পর দেখা হলো রোজী।চিনতে পারছো আমাকে?

-চিনেছি।তুমি স্যামসাং গ্যালাক্সি জে-ফাইভ মডেলের ফোন।আমি আসার আগে তুমি তিতলীর প্রিয় সেলফোন ছিলে।

-বাহ তোমার স্মৃতি শক্তি খারাপ নয়!

-তা তো বটেই।৪ জিবি র‍্যাম আর ৬৪ জিবি রম আমার।আমার স্মৃতিশক্তি তোমার চেয়ে হাজার গুন ভাল হবে এটাইতো স্বাভাবিক।তাই না গোল্ডি?

-লকারে আসার মানে বোঝ রোজী?তোমাকে ওরা আর চায় না।এখনো তোমার কিসের এত দেমাগ বলতো? রোজী চুপ করে থাকে।গোল্ডি ভুল কিছু বলেনি।তিতলী আর তাকে চায় না।গতকাল তিতলী স্যামসাং গ্যালাক্সি এ ফিফটি ওয়ান কিনে এনেছে মার্কেট থেকে।অবশ্যই প্রায় মাস খানেক ধরে সে এ ফিফটি ওয়ান এর রিভিউ দেখছিল।তখনই রোজী বুঝতে পেরেছিল তার সময় ফুরিয়ে আসছে।ভীষণ রাগ হতো তিতলীর উপর।ইচ্ছে করতো হ্যাং মারতে।কিন্তু তার প্রসেসর সাহেব খুবই লয়েল।চাইলেও হ্যাং মারার সুযোগ ছিল না।

গোল্ডি গলা খাঁকারি দিল একবার।

-মন খারাপ করে লাভ নেই রোজী।বন্ধুত্ব করে নেওয়াই ভাল।কি বল তুমি?

-হ্যাঁ সেটাই।এসে যখন পড়েছি কি আর করা।

-তারপর বল!তিতলী কেমন আছে?তার সেই বয়ফ্রেন্ড এখনো আছে না গেছে?

-আছে এখনো।তবে ওদের খুব ঝগড়া হয় আজকাল।

-তা তো বুঝতেই পারছি তোমার চেহারা দেখে।তোমার স্ক্রিন তো আফ্রিকার ম্যাপ হয়ে গেছে।ডিসপ্লের কথা নাই বা বললাম।

-মজা করবে না আমাকে নিয়ে।নিজের চেহারা দেখেছো আয়নাতে?

-আমি যথেষ্ট আদর যত্নে ছিলাম রোজী।তিতলীর তখন নতুন নতুন প্রেম হয়েছিল।নতুন নতুন ফোনে চুমু খাওয়া শিখেছিল।বুঝতেই পারছো আমার কদর!

-তোমার স্ক্রিনটা কি চুমু খেতে খেতে গলে গেছে?পোড়া বেগুনের মত চেহারা হয়েছে কেন তোমার?

-বাজে কথা বলবে না রোজী।তিতলীর এইচএসসি পরীক্ষার আগে ওর ফোন ব্যবহার করা বারণ ছিল।তখন মিসেস শামীম আরা আমাকে ব্যবহার করতেন।উনার অসাবধানতার কারণে আমার স্ক্রিনের একপাশে একটু গরম ডেকচির ছ্যাঁকা লেগে গেছিল।তোমার চেয়ে হাজারগুন ভাল অবস্থায় আছি এখনো।

-তুমি কি এখনো হ্যাং মারো গোল্ডি?

-চুপ কর রোজী।

এই মেয়েরা তোমরা থামবে!কে যেন খেঁকিয়ে উঠলো।রোজী ভয় পেয়ে গেল।

গোল্ডি ফিসফিস করে বলল, -ভয় পেও না রোজী।ও হলো নোকিয়া ১২০০।বুড়িটা সারাদিন খেট খেট করে।এন্ড্রয়েড দেখলেই ওর হিংসায় গা জ্বলে। এর মধ্যেই নোকিয়া ১২০০ তাদের কাছাকাছি চলে আসলো।রোজীকে একবার ভাল করে দেখে নিল।তারপর নিজের গল্প বলা শুরু করলো।

-আজকাল কিসব সেট আসছে বাজারে টোকা লাগলেই ভেঙ্গে যাচ্ছে। রোজীর ভীষণ রাগ হলো।

-টোকা বলছেন আপনি?তিতলীর রাগ সম্পর্কে কোন ধারণা আছে আপনার?আমার মত মজবুত সেট বাজারে খুব কমই আছে বুঝলেন?

-আরে থামো তুমি।তিতলী তো সেদিনের মেয়ে।ওর বাবা যখন আমাকে কিনে এনেছিল তিতলী তখন ফিডার খায়।ওই একরত্তি মেয়ের আবার রাগ!!তিতলীর বাবাকে দেখেছো!দেখতে যেমন জমের মত তার রাগও জমের মত।আমাকে কতবার অসুরের মত আছাড় মেরেছে হিসেব নেই।আমি নীরবে সহ্য করেছি।তোমাদের মত ননীর পুতুল নই বুঝলে?

রোজীর ব্যাটারী রাগে ঝিম ঝিম করছে।

গোল্ডি তাকে চিমটি কেটে চুপ থাকার ইশারা দেয়।নোকিয়া বুড়ি বকতে বকতে ঘুমিয়ে পড়েছে।

গোল্ডি একচোট হেসে নেয়।রোজীর সাথে তার বন্ধুত্ব জমে উঠতে শুরু করে।দুজনে অনেক গল্প করে।গোল্ডি তার প্রথম জীবনের গল্প বলতে শুরু করে।তিতলীর এসএসসি পরীক্ষার পর তিতলীর বাবা গোল্ডিকে উপহার হিসেবে কিনে এনেছিল তিতলীর জন্য।সে ছিল তিতলীর কলেজ জীবনের সারথি।তিতলীর প্রথম প্রেমে পড়া,প্রথম ডেটিং সবকিছুর স্বাক্ষী গোল্ডি।কিশোরী তিতলীর স্তুতি গেয়ে শেষ করতে পারে না সে। রোজীও গল্প জুড়ে দেয়।বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পর তিতলী কতটা প্রাণবন্ত ছিল।অথচ এখন সে হতাশ হতে হতে নিজেকে একেবারে গুটিয়ে ফেলেছে।হাসিখুশী নরম-সরম মেয়েটা কেমন বদমেজাজী হয়ে গেছে সেসব গল্প শুরু করলো। দুজনের মুখেই তিতলীর বন্দনা।অথচ ওইদিকে তিতলী তার নতুন ফোন পেয়ে দুনিয়াদারি সব ভুলতে বসেছে!